শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জজ মিয়া নাটক উন্মোচনের কাহিনী

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইতিহাসের নারকীয় সেই গ্রেনেড হামলার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা করে। পরদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে পুলিশ তা নেয়নি। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। শুরু থেকেই তদন্তের গতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার  চেষ্টা করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে আটক করে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। তদন্তের নামে পুরো ঘটনাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা হয় সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে।

ঘটনার গুরুত্ব নষ্ট করতে হামলার শিকার আওয়ামী লীগের দিকেই সন্দেহের আঙুল তুলেছিল বিএনপি। ওই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতা তাদের বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ নিজেরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রচার চালান। ঘটনার ১০ মাসের মাথায় সিআইডি আকস্মিক জানান দেয়, গ্রেনেড হামলার এক আসামি ধরা পড়েছে। গ্রেনেড হামলাকারী কারা, তাদের পরিচয় কী— এসব প্রশ্ন যখন মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল ঠিক তখনই সিআইডির এমন এক ঘোষণায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সিআইডি জানায়, এ ঘটনার অন্যতম হামলাকারী জজ মিয়া তাদের কব্জায়। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের বাড়ি থেকে জজ মিয়াকে তারা আটক করে। ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে জজ মিয়াকে জেরা চলে। কিন্তু সিআইডির কথাবার্তায় সন্দেহ দেখা দেয় সর্বমহলে। সিআইডি তার কাছ থেকে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে এবং তদন্তের নামে নাটক প্রচার করেন মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ ও তৎকালীন বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। সিআইডির এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনিও সাজানো ছকে কথিত তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যান। এই গল্প সাজানোর ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বলে পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।

ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি; গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। আর বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। নারকীয় এই হামলায় দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে সিআইডি তদন্ত এক প্রকার শেষ করে। এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর থেকেই সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছে। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার গ্রাম থেকে দিনমজুর সহজ-সরল জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে সিআইডি। এ মামলায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে সিআইডির তৎকালীন তিন কর্মকর্তা (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও আদায় করে নেন। বিনিময়ে তার মাকে প্রতি মাসে সংসার খরচের জন্য দুই হাজার টাকা করে নিয়মিত প্রদান করেন তারা। জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে আনার সময় তার মা জোবেদা খাতুনকে সিআইডির সে সময়ের বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিক ও আবদুর রশীদ বলেছিলেন, ‘আপনার ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি। তাকে ভালো চাকরি দেব, আপনারা সুখে থাকবেন।’ অশিক্ষিত জোবেদা খাতুন সুখে থাকার আশ্বাসে সরল বিশ্বাসে তা মেনে নেন। কিন্তু জজ মিয়াকে শেখানো বুলি সঠিকভাবে বলার জন্য দিনের পর দিন সিআইডি দফতরে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। অমানুষিক নির্যাতনের পর মিথ্যা কথা বলতে রাজি হয় জজ মিয়া। এক পর্যায়ে আসল ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কর্মকর্তারা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন। সেই সময় এ নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই জেলহাজত থেকে ছাড়া পান জজ মিয়া। বিনা অপরাধে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় মূল্যবান চারটি বছর। সত্য উদ্ঘাটনের শুরু : ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এ মামলা তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তাতে বেরিয়ে আসে, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সহযোগিতায় গোপন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) জঙ্গিরা শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল।

তদন্ত শেষে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে আদালতে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন। তাতে ২২ জনকে আসামি করা হয়। সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ছাড়া বাকি আসামিদের সবাই হুজি-বির জঙ্গি।

সর্বশেষ খবর