শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

তিতলির জোয়ারে প্লাবিত চট্টগ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

তিতলির জোয়ারে প্লাবিত চট্টগ্রাম

ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে গতকাল প্লাবিত চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলি’র প্রভাবে গতকালও দিনভর কখনো থেমে, কখনো মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। দুপুরের পর বিকাল পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। এর সঙ্গে ছিল জোয়ারের পানি। ফলে নগরের অধিকাংশ নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, ভারতের উড়িষ্যা এবং তত্সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় তিতলি সামান্য উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে একই এলাকায় নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। গতকাল ভোর ৬টায় উড়িষ্যা ও তত্সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় এটি অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড়টি আরও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমে দুর্বল হতে পারে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। কিন্তু সকাল ৯টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ছিল ৪৫ দশমিক ২ মিলিমিটার। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মেঘনাদ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতিভারি বর্ষণ হতে পারে— এমন সতর্কবাণী ছিল। সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৫ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।’ এদিকে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানির কারণে নগরের নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় গতকাল স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও কর্মস্থলগামী মানুষের দুর্ভোগ না থাকলেও সাধারণ পথচারী, মজুর, শ্রমিক আর নিম্ন আয়ের মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে। জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে নগরের নিম্নাঞ্চল বাকলিয়া, হালিশহর, বড়পুল, ছোটপুল, পতেঙ্গাসহ আশপাশ এলাকায়।

শাহ পরীর দ্বীপে ব্যাপক ভাঙন : কক্সবাজারের টেকনাফ শাহ পরীর দ্বীপ বেড়িবাঁধের অরক্ষিত অংশে জোয়ারের পানি ঢুকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, মসজিদ, ফসলি জমিসহ নানা স্থাপনা। গত তিন দিনে জোয়ারের পানি ও অবিরাম বর্ষণের তোড়ে দ্বীপের দক্ষিণপাড়া, মাঝের পাড়া ও জাইল্যা গোদা গ্রামের দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ভিটেমাটিহারা মানুষ আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-পড়শির বাড়িতে।

টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহ পরীর দ্বীপ তলিয়ে যাওয়ার মুখে পড়েছে। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী এলাকায় জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে গেছে অর্ধশতাধিক বসতঘর ও দোকান। স্থানীয়রা জানান, সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের আঘাতে সাবরাং ইউনিয়নের শাহ পরীর দ্বীপ দক্ষিণপাড়া, মাঝের পাড়া ও জালিয়াপাড়ার ঘেরসংলগ্ন অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইউনিয়নের ঘোলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া, মাঝের পাড়া ও জালিয়াপাড়ার একাংশে ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে চলেছে।

মাঝের পাড়া গ্রামের বাসিন্দা হালিমা খাতুন গতকাল বলেন, ‘বুধবার রাতে জোয়ারের পানিতে আমার ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এখন আমাদের থাকার মতো কোনো জায়গাজমি নেই। আপাতত এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এর পরে আমার পরিবারের ঠাঁই কোথায় হবে জানি না।’ দ্বীপের বাসিন্দা সাবেক স্কুলশিক্ষক জাহেদ হোসেন বলেন, ‘বেড়িবাঁধ নির্মাণ একদিকে চললেও অন্যদিকে খোলা রয়েছে। এই খোলা অংশ দিয়ে এখন পানি ঢোকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে। আগেই পুরো এলাকা জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধের ব্যবস্থা করা গেলে অনেক ঘরবাড়ি রক্ষা পেত।’ কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘শাহ পরীর দ্বীপে জোয়ারের পানিতে বেশকিছু ঘরবাড়ি উচ্ছেদ হয়েছে। আমি নিজেও এখন দ্বীপে অবস্থান করছি। আমরা আপাতত জিও টেক্সটাইল দিয়ে রক্ষাবাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আশা করি এতে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমে আসবে।’

উল্লেখ্য, ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে কক্সবাজারে হালকা বাতাস ও বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, সাগর উত্তাল রয়েছে। গত চার দিন থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ ড. মো. শহিদুল ইসলাম জানান, ‘ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব ধরনের মাছ ধরার নৌকা, ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি বাতাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে পারে।’

রোহিঙ্গা শিবিরে দুর্ভোগ : কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, ভারি বৃষ্টিপাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। তারা নানাভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, ঘূর্ণিঝড় তিতলির মোকাবিলা করার জন্য উপকূলীয় এলাকাসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে আগেই প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার পরও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন এনজিওর নিয়োগকৃত স্বেচ্ছাসেবীদের সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পে পাহাড়ের ওপরে, ঢালুতে বা নিচে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের এনজিওর বিভিন্ন অবস্থানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী রয়েছে, যা দিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব হবে।

আজও বৃষ্টি হবে : তিতলির প্রভাবে রংপুর ছাড়া অন্য বিভাগগুলোয় আজও ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এজন্য সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আগামীকাল রবিবার দুপুর পর্যন্ত আবহাওয়া অপরিবর্তিত থাকবে। এরপর তা স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, দুর্বল হয়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় তিতলি আজ দুপুরের দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এটি সাতক্ষীরা হয়ে যশোর, ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে মৌলভীবাজার হয়ে ত্রিপুরায় গিয়ে শেষ হবে।

গতকাল সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদফতর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আবহাওয়াবিদরা জানান, ঘূর্ণিঝড় তিতলি আরও দুর্বল হয়ে ভারতের উড়িষ্যা ও আশপাশের উপকূলীয় এলাকা থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এটি আরও উত্তর-উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে একই এলাকায় গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে সঞ্চারণশীল মেঘমালা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তিতলির প্রভাবে গতকাল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আকাশ মেঘলা ছিল। এ ছাড়া দিনভর থেমে থেমে গুঁড়ি ও ভারি বৃষ্টিপাত হয়। টানা বৃষ্টিপাতের জন্য আবহাওয়ায় শীত শীত আমেজও ছিল। সরকারি ছুটির দিন হলেও এমন আবহাওয়ার মধ্যেই গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর