শনিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

যেভাবে মাদক সিন্ডিকেটে চার পুলিশ

সাখাওয়াত কাওসার

লবণের ট্রাকে করে কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় ইয়াবার চালান আসছে। চালানটি গ্রহণ করবেন সম্প্রতি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ওরফে বাবা আরিফের স্ত্রী সাবিনা আক্তার রুনুসহ পুলিশের উপ-পরিদর্শক বিল্লাল। গত ৭ মার্চের এ ঘটনাটি আগেই টের পেয়ে যান আরেক পুলিশ কর্মকর্তা সহকারী উপ-পরিদর্শক হাসান। আরও দুই পুলিশ সদস্যকে দিয়ে ওই মাদকের চালানসহ মাদক ব্যবসায়ীদের জিম্মি করার পরিকল্পনা করেন তিনি। তবে পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি টের পেয়ে যাওয়ায় ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। প্রথমে বন্দর থানায় মামলা পরবর্তীতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের সদস্যরা এর আদ্যোপান্ত বের করে। গ্রেফতার করে দুজন উপ-পরিদর্শক, দুজন সহকারী উপ-পরিদর্শক, একজন কনস্টেবলসহ ১১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে। এর মধ্যে ১০ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সূত্র জানায়, খুব শিগগিরই আদালতে মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, মাদক মামলার তদন্ত অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তাদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা পুরো চক্রটির সন্ধান পেয়েছি। এখন আমরা মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মুন্সীগঞ্জের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন সাইফুল ইসলাম আরিফ ওরফে বাবা আরিফ। গত ২৫ এপ্রিল পুলিশের সঙ্গে সদরের চর হাইদ্রাবাদ এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় বাবা আরিফ। এক সময় মুন্সীগঞ্জে কর্মরত ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত এমন অনেক পুলিশ সদস্যের সঙ্গেই বাবা আরিফের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পর অসুস্থতার ভান করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আরিফ। সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন ইয়াবা সিন্ডিকেট। মাদারীপুর হাইওয়ে পুলিশের এসআই বিল্লাল, নরসিংদীর বেলাব থানায় কর্মরত এসআই মোরশেদ মুন্সীগঞ্জে (কর্মরত থাকাকালে) বাবা আরিফের সঙ্গে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যান। অন্য এলাকায় বদলি হয়ে গেলেও তারা বাবা আরিফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন। সূত্র আরও বলছে, গত ৭ মার্চ ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসআই বিল্লাল টেকনাফ থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবার চালান আনায়। আপাতত পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে জানালে আরিফ সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে তার স্ত্রী রুনুকে ইয়াবার চালান গ্রহণ করতে বলে। তবে তাদের কথোপকথন জেনে যান সেসময় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে কর্মরত এএসআই হাসানুল হক হাসান। বিষয়টি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে গোপন রেখে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় কর্মরত তার ব্যাচমেট এএসআই আলম সোহরাওয়ার্দী রুবেলকে জানান। এএসআই রুবেল তাত্ক্ষণিক কাওসার আহমেদ রিয়েল নামে এক সোর্সকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান বন্দর থানাধীন মদন বাসস্ট্যান্ডে। ঘটনাস্থলে গিয়ে সে ৫০ হাজার পিস ইয়াবাসহ রুনু এবং রহমান নামে এক যুবককে আটক করে বন্দর উপজেলার রূপালী আবাসিক এলাকায় তার নিজ বাসায় নিয়ে যান। তবে পাশেই অবস্থান করা এসআই বিল্লাল ও আরেক মাদক ব্যবসায়ী মৌসুমী সটকে পড়ে। এ সময় রুবেলের সঙ্গে যোগ দেয় সদর থানার আরেক কনস্টেবল আসাদ। এসআই বেলাল ঘটনাটি জানান বাবা আরিফকে। আরিফ সঙ্গে সঙ্গে এসআই মোর্শেদকে জানায়। এসআই বিল্লাল এবং এসআই মোর্শেদ মিলে পাঁচ লাখ টাকা এবং ৫০ হাজার ইয়াবার বিনিময়ে রুনুকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এ বিষয়টি বাবা আরিফ পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানালেন তার নিজের মতো করে। ওই কর্মকর্তা বিষয়টি নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার মইনুল হককে অবহিত করলে রাতেই এএসআই রুবেলের বাসায় ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৪৯ হাজার পিস ইয়াবা, রুনু এবং রুবেলকে গ্রেফতার করে। ঘটনার পরদিন চলতি বছরের ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর মাসুদ বাদী হয়ে মাদক ব্যবসায়ী আরিফ, তার স্ত্রী রুনু, এএসআই আলম সোহরাওয়ার্দী রুবেল ও তার সোর্স কাওসার আহমেদ রিয়েলকে আসামি করে মামলা (নং ২৪) দায়ের করে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটকে।

সিআইডি সূত্র বলছে, গ্রেফতার রুনু ও এএসআই রুবেলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২৫ এপ্রিল কুমিল্লা থেকে হেলপার রহমানকে গ্রেফতার করে। ইয়াবা মামলায় গ্রেফতার ট্রাকচালক বেলাল ও তার আরেক সহযোগী জয়নাল আবেদীন ছোটনকে শ্যোন অ্যারেস্ট করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। চলতি বছরের ৮ মে সোর্স কাওসার আহমেদ রিয়েল, ১৫ মে এসআই বেলাল ও কনস্টেবল আসাদকে, ২০ মে নরসিংদীর এসআই মোর্শেদকে এবং ৫ জুন এএসআই হাসানুল হক হাসানকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরপরই কাউন্টার টেররিজম থেকে তাকে বদলি করে ঢাকা জেলা পুলিশে পাঠানো হয়েছিল। সর্বশেষ গত ৮ অক্টোবর চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী শরফুদ্দীনের স্ত্রী মৌসুমী আক্তারকে মুন্সীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে সিআইডি। ৯ অক্টোবর মৌসুমী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।

সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মেহেদী মাসুদ বলেন, গ্রেফতার ১১ জনের মধ্যে এসআই মোর্শেদ ছাড়া বাকি সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে টেকনাফ থেকে ইয়াবাগুলোর চালান পাঠানো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর