বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস আজ

উত্থান পতনের বৃত্তে দশ সূচক

মানিক মুনতাসির

উত্থান পতনের বৃত্তে দশ সূচক

ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের টানা ১০ বছরের শাসনের শেষ মুহূর্তে অর্থনীতি মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। অন্যদিকে সরকার মনে করছে, দেশের অর্থনীতিতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। কেননা দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে দ্রুত গতিতে। বর্তমানে ২৪ শতাংশের বেশি মানুষ দরিদ্র সীমার নিজে বসবাস করছে। ২০১০ সালে এই হার ছিল ৩০ শতাংশের বেশি। সহজ হিসাবে ১০ বছরে এক কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার ওপরে উঠে এসেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আজ দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। অন্যদিকে মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১৭৫২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৬ ও ৭ শতাংশের বৃত্ত ভেঙে প্রায় ৮ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ না বাড়লেও সরকারি খাতের বিনিয়োগ বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে ৩১ বিলিয়ন ডলারে ছাড়িয়েছে। ফলে মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ও মানব উন্নয়ন সূচক এই তিন মানদণ্ডে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বহির্বিশ্বে শ্রমবাজারের সংকট মোকাবিলা করতে না পারায় ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। রপ্তানির চেয়ে আমদানি ব্যয় অনেক গুণ বেশি হওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতিতেও ৪৭ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ২০১০ সালে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৭৬-৭৮ টাকায় উঠানামা করলেও এখন গুনতে হচ্ছে ৮৪-৮৬ টাকা পর্যন্ত। এতে ১০ বছরে টাকার মান ডলারের বিপরীতে প্রায় এক টাকা করে কমেছে। সরকারের ব্যয়ের তুলনায় আয়ের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় বাজেট ঘাটতি বেড়ে তা এখন ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা মোট জিডিপির ৫ শতাংশের কিছুটা বেশি। বাসা ভাড়া, পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ব্যয়সহ বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ শতাংশের ঘরেই রয়েছে। যদিও এটাকে অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সরকার বলছে জিনিসপত্র জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে বলেই মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বেকার সমস্যার সমাধানে ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সরকার প্রথম মেয়াদ থেকে সোচ্চার হলেও এতে তেমন একটা সাফল্য আসেনি। ফলে প্রতি বছর ২৬ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হলেও কর্মসংস্থান হয়েছে ৬-৭ লাখ মানুষের। সরকার বলছে, মানুষ এখন আত্মকর্মসংস্থানের দিকে ঝুঁকছে। এ ছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির সুযোগ তৈরি না হওয়ায় শিক্ষিত যুব সমাজের একটা বড় অংশ স্বেচ্ছা বেকার থাকছে। তবে দেশজুড়ে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে এতে আগামী ১৫ বছর পর বেকার সমস্যা বলতে কিছু থাকবে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

কর্মসংস্থানহীন জিডিপি বাড়ছে : ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশের ঘরে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছর শেষে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। এমনকি ২০২১ সালের আগেই জিডিপি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাবে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন। অবশ্য বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি বছর জিডিপি হতে পারে ৭ শতাংশ। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৭ দশমিক ১ শতাংশ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে। যদিও সে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ বেকার থাকছে। আর দেশে বর্তমানে বেকার সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি ভালো সংকেত বহন করে না। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না বাড়লেও জিডিপি প্রতি বছরই বাড়ছে। এটা প্রশ্নবিদ্ধ হতেই পারে। কেননা বিশ্বব্যাংক ও বিবিএসের হিসাবে গত দুই বছরে মাত্র ১৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ প্রতি বছর প্রায় ২৭ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হচ্ছে।

মাথাপিছু আয় ১৭৫২ ডলার : সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১৭৫২ ডলারে। যা বাংলাদেশি টাকায় দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি। অথচ ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৭৫০ ডলারে। সে হিসাবে গত ১০ বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণেরও বেশি হারে বেড়েছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন বেড়েছে তেমন জীবন মানেরও উন্নয়ন হয়েছে। এর পাশাপাশি মানব সূচক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। যার স্বীকৃতি স্বরূপ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।

হতদরিদ্র কমেছে এক কোটি : দেশে এখন হতদরিদ্রের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সংখ্যায় হিসাব করলে তিন কোটি ৮৮ লাখ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। ২০১০ সালের জরিপে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। সংখ্যায় হিসাব করলে প্রায় পাঁচ কোটি। আর সর্বশেষ ছয় বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। অবশ্য দারিদ্র্য কমার এই হার আগের ছয় বছরের চেয়ে কম। তবে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, গত ছয় বছরে যে হারে দারিদ্র্য কমেছে সে হারে কর্মসংস্থান হয়নি। এ সময়ে মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। একই সঙ্গে প্রবাসী আয়ও কমে গেছে। অন্যথায় দারিদ্র্য বিমোচনের চিত্র আরও অন্য রকম হতে পারত বলে তিনি মনে করেন।

রিজার্ভ বেড়েছে তিন গুণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যা দিয়ে অন্তত কয়েক বছরের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এমনকি গত জুন মাসে এ রিজার্ভ ছিল ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সাল শেষে রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না হওয়ায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেছে। তবে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির আমদানি বেড়েছে। এ ছাড়া রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।

বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা : সরকারের তথ্য অনুসারে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগ এখনো ২৩ শতাংশে থেমে রয়েছে। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ এখন ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ।

রেমিট্যান্সে ছন্দপতন, অসম আমদানি-রপ্তানি : ঈদুল আজহার মাস গত আগস্টেও খুব ভালো রেমিট্যান্স এসেছিল। তবে গত সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ করেই কমে গিয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের পরিমাণ। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১১২ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। যা গত ১১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত অর্থবছরের একই মাসে সর্বনিম্ন ৮৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল।

এদিকে জনশক্তি রপ্তানিও দিন দিন কমছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে তিন লাখ ৯২ হাজার ২৫০ জন। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম।

বাণিজ্য ঘাটতিতে রেকর্ড : দেশের আমদানি খাতে ব্যয় বাড়লেও বাড়ছে না রপ্তানি আয়। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। যা স্বাধীনতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত অর্থবছরে যে পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে স্বাধীনতার পর তা কখনো হয়নি।

খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি : অব্যাহত অনিয়ম-দুর্নীতিতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা।

এই সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। সে হিসাবে খেলাপি ঋণ মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। আর গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৫১ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৫ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। যা ব্যাংক পুরো খাতকে সংকটে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর