বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জামিন পেয়েই ফের জঙ্গিবাদে নারীরা

নরসিংদীতে দুজনের আত্মসমর্পণ

সাখাওয়াত কাওসার

জামিন পেয়ে ফের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন নারী জঙ্গিরা। নরসিংদীর অভিযানে এদের একজন নিহত এবং অপর দুজন আত্মসমর্পণ করেছেন। সোমবার রাত থেকে ঘিরে রাখা গাংপাড় এলাকার ভগীরথপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে গতকাল আত্মসমর্পণ করেন খাদিজা আখতার ওরফে মেঘলা ও ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমী ওরফে মৌ। আগের দিন মঙ্গলবার নরসিংদীর আরেক আস্তানায় সোয়াতের ‘অপারেশন গার্ডিয়ান নট’ অভিযানে নিহত হয় দুই জঙ্গি। এদের মধ্যে রয়েছেন নারী জঙ্গি আকলিমা রহমান ওরফে মনি (২৩)। পৃথক দুটি স্থানে আস্তানা গেড়ে এই নারী জঙ্গিরা বড় ধরনের হামলার ছক আঁকছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য দিয়ে বলেছে, এই তিন নারী জঙ্গি আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জামিনে ছাড়া পেয়েই তারা ফের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

র‌্যাব সূত্র বলছে, ২০১৬ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট গাজীপুর ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমী ওরফে মৌ (২২), খাদিজা পারভীন ওরফে মেঘলা (২৩), আকলিমা রহমান ওরফে মনি (২৩) এবং ইসতিসনা আক্তার ওরফে ঐশী গ্রেফতার হন। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল জামিনে বের হয়ে আসেন মনি ও মৌ। মেঘলা জামিন পেয়েছিলেন ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ। এ ছাড়া ইসতিসনা আক্তার ওরফে ঐশী জামিন পান আরও কয়েক দিন পর। জামিনে ছাড়া পেয়েই এরা আবারও জঙ্গিবাদে কাজ শুরু করেন। ঐশী ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন। বাকিরা মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাদের আরেক সহযোগী শাহনাজ আকতার ওরফে সাদিকা ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ডেমরা থেকে গ্রেফতার হন। গত দুই দিনের অভিযানে মনি নিহত এবং মেঘলা ও মৌ এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কব্জায়। এ বিষয়ে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাস জেল খাটার পর বেরিয়ে এসে মেঘলা, মৌ ও মনি আবার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন। মেঘলা ও মৌকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিহত দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন আকলিমা আকতার ওরফে মনি ও আবু আবদুল্লাহ আল বাঙ্গালি। নিহত আবু আবদুল্লাহ আল বাঙ্গালি হলেন নব্য জেমএবির মিডিয়া শাখার প্রধান। তাদের আরও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তিনি জানান। জানা গেছে, জঙ্গি আস্তানায় থাকা নারীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানারাতের ছাত্রী ছিলেন। আত্মসমর্পণ করা দুই নারী জঙ্গির কাছে কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য ছিল। পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা বিস্ফোরণও ঘটান। কিন্তু পরে তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো নিষ্ক্রিয় করে পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। সূত্র বলছে, ২০১৬ সালে ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমী ওরফে মৌ থাকতেন মিরপুরের জনতা হাউজিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে। তার ফ্ল্যাটেই নারী জঙ্গিরা নিয়মিত বৈঠক করত। ‘আত্মীয়’ পরিচয়ে সবাইকে বাসায় নিয়ে যেতেন মৌসুমী। ওই ভবনের ফ্ল্যাট মালিকদের সমিতি বিষয়টি আঁচ করতে পারে। এরপর নেকাবে মুখ ঢেকে বাসায় প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সূত্র জানায়, মৌসুমী ওরফে মৌ মিরপুরের ইসলামিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর ২০১২ সালে মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের বিসিআইসি কলেজ থেকে জিপিএ-৪.৬০ পেয়ে তিনি এইচএসসি পাস করেন। এরপর মেডিকেল ও ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ফার্মগেটের ইউসিসি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। ২০১৩ সালে তিনি মানারাত ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। গ্রেফতারের আগে মৌ অনার্স শেষ বর্ষ সপ্তম সেমিস্টারে পড়ছিলেন। মেঘলা ২০১৩ সালে জিপিএ-৪.৭০ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। ওই বছরই রোকনুজ্জামান নামে এক যুবকের সঙ্গে তার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তিনিও গ্রেফতারের আগে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসি বিভাগে অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রসঙ্গত, সোমবার দিবাগত রাত থেকে নরসিংদীতে সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানা হিসেবে দুটি বাড়ি ঘিরে রাখেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি শাখার সদস্যরা। গতকাল সকাল থেকে নরসিংদীর গাংপাড় এলাকায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে রাখা বাড়ির ভিতর থাকা ‘জঙ্গিদের’ আত্মসমর্পণের অনুরোধ জানায় পুলিশ। ড্রোনে অ্যান্ডোস্কোপিক ক্যামেরা ব্যবহারের মাধ্যমে সন্দেহজনক ফ্ল্যাটের ভিতর পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। বাড়ির চারপাশে পুলিশের কর্ডন করে রাখা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। অবশেষে রক্তপাত ছাড়াই গতকাল ওই বাসায় অভিযান শেষ হয়। দুই নারী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেন।

নরসিংদীতে দুই নারী জঙ্গির আত্মসমর্পণ : অবশেষে নরসিংদীর মাধবপুরের একটি ভবনে থাকা দুই নারী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে। গতকাল ভোর থেকে টানা চেষ্টার পর দুপুরে সোয়াত সদস্যদের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করে। তাদের নাম খাদিজা আক্তার মেঘলা (২৪) ও ইশরাত জাহান মৌ (২০)। কয়েক মাস জেল খেটে এসে তারা ফের নব্য জেএমবির জঙ্গি সংগঠনে সক্রিয় হয়েছিল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বিকাল পৌনে ৩টার দিকে মাধবদী বড় মসজিদের সামনে প্রেস ব্রিফিংয়ে আত্মসমর্পণের বর্ণনা দেন। তিনি জানান, এর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে ৪০ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশন গার্ডিয়ান নট। মনিরুল ইসলাম বলেন, দুই নারীই নব্য জেএমবির সদস্য। তারা মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর মিরপুর মডেল থানা পুলিশের হাতে তারা গ্রেফতার হয়েছিল। প্রায় এক মাস কারাবন্দী থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসে। আত্মসমর্পণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সোয়াত গতকাল সকাল থেকেই তাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা  করছিল। সকালের দিকে ভবনের ভিতর জঙ্গিরা বিস্ফোরণও  ঘটায়।  দুপুরের দিকে জঙ্গিরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়। আড়াইটার দিকে তারা আত্মসমর্পণ করে। অভিযান সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে পুলিশের কোনো সদস্য হতাহত হয়নি। আত্মসমর্পণকৃত দুজনের বিরুদ্ধে মাধবদী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হবে। মনিরুল ইসলাম গত মঙ্গলবার নরসিংদীর শেখেরচর ভগিরথপুর এলাকার জঙ্গি আস্তানায় নিহত দুজনের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করেন। তিনি জানান, তারা হলো আবু আবদুল্লাহ আল বাঙ্গালি (২৬) ও মনি (২০)। তারা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। এর আগের ঘটনা সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, দেশের শিল্পাঞ্চল খ্যাত নরসিংদীর মাধবদীতে ঘাঁটি গেড়েছিল জঙ্গিরা। ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকার দুই স্থানে বিলাসবহুল বাড়ি ভাড়া নিয়ে তারা চালাচ্ছিল তাদের কার্যক্রম। দুর্গাপূজা ও সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বড় ধরনের হামলার উদ্দেশ্যেই তারা এখানে সংগঠিত হয়। কিন্ত নব্য জেএমবির এসব কর্মকাণ্ড পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটিটিসি) ইউনিট শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। সে অনুযায়ী গত মঙ্গলবার সদর উপজেলার শেখেরচরের ভগিরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকায় ব্যাপক গুলি বিনিময় শেষে দুই জঙ্গির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় প্রথম দফার অভিযান। এরপর মাধবদী পৌরসভা সংলগ্ন ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকার ‘নিলুফার ভবন’ নামের ৭ তলা জঙ্গি আস্তানাটি ঘিরে ফেলা হয়। ভবনের তৃতীয় তলায় ‘মিততাহুল জান্নাহ মহিলা মাদ্রাসা’ নামে একটি মাদ্রাসা রয়েছে। ভবনটির ৭ তলায় জঙ্গিদের অবস্থান চিহ্নিত করে পুলিশ। ফ্ল্যাটটি ৬ মাস আগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার হাফিজ ভূইয়া নামে এক ব্যক্তি ভাড়া নিয়েছিল। তিনি জানান, ‘অপারেশন গার্ডিয়ান নট’ নামের দ্বিতীয় অভিযানটি পরিচালনা করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

সর্বশেষ খবর