বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বৈঠক প্রধানমন্ত্রীর

বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান সমঝোতা স্বাক্ষর

প্রতিদিন ডেস্ক

বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান সমঝোতা স্বাক্ষর

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ —পিআইডি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক।

গতকাল স্থানীয় সময় দুপুরে রিয়াদের রাজপ্রাসাদে শেখ হাসিনার সঙ্গে বাদশাহ সালমানের বৈঠক হয়। পরে তারা মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। খবর বাসস ও বিডিনিউজের। পররাষ্ট্র সচিব বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাদশাহ বলেছেন উন্নয়নের ধারাবাহিকতা দরকার। এতে তো বোঝা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিকতার কথা বলেছেন। এটা হলে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।’ সৌদি আরবে চলতি বছর এটি প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফর। গত এপ্রিলে সৌদি আরব, বাংলাদেশসহ ২২ দেশের সামরিক মহড়া ‘গাল্ফ শিল্ড-১’ এর সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এর আগে সৌদি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানান। শহীদুল হক বলেন, সৌদি বাদশাহর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এবারের বৈঠকও ‘অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও উষ্ণ পরিবেশে’ হয়েছে। কয়েকটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ মানবিক গুণাবলি নিয়ে বলেছেন, সব মুসলমানের প্রতি তার কর্তব্য রয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনেরও প্রশংসা করেছেন তিনি। পররাষ্ট্র সচিব জানান, বাদশাহ তার প্রাসাদের গাড়ি বারান্দায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে ভিতরে নিয়ে যান। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘এটা আপনার বাড়ি, আপনি সব সময় এখানে আমন্ত্রিত।’ শহীদুল হক বলেন, মধ্যাহ্নভোজের সময় বাদশাহ নিজে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে খাবার ঘরে যান। তিনি সৌদি আরবের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার দেখিয়ে সেগুলোর নাম প্রধানমন্ত্রীকে বলেন। বৈঠকে বাদশাহ সালমান অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে দুই দেশের সহযোগিতার সুযোগগুলো আরও কাজে লাগানোর ওপর জোর দেন বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। পরে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীও সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক। খুব ভালো আলোচনা হয়েছে। সৌদি বাদশাহকে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে আসবেন।’

যুবরাজের সঙ্গে বৈঠক : সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হয়েছে। বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় রিয়াদের রাজকীয় প্রাসাদে এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, আইসিটি সচিব জুয়েনা আজিজ এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব রৌনক জাহান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে মঙ্গলবার সৌদি আরব পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার তিনি মক্কায় ওমরাহ পালন করবেন। সফর শেষে শুক্রবার তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

উন্নয়নের অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরু করেছে এবং এই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না। তিনি গতকাল বিকালে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিজস্ব জায়গায় এবং নিজস্ব অর্থে নবনির্মিত চ্যান্সেরি ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশকে উন্নয়নে যে কাজটা করার দরকার ছিল আমরা তা করেছি এবং বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা শুরু করেছে। এ অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না বলে আমি বিশ্বাস করি এবং এই দায়িত্বটা আপনাদের সবার থাকল।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় উল্লেখ করেন, সামনে নির্বাচন এবং জনগণ ভোট দিলে তিনি আবার সরকারে আসবেন, না হলে নাই। বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারার জন্য তার কোনো আফসোস থাকবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এবং সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে এস এ গোলাম মসীহ বক্তৃতা করেন। প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাসহ সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য ৫১০ বর্গমিটারের একটি শেডও নির্মাণ করা হয়েছে।

রিয়াদে চেম্বার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থে সৌদি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ ব্যাপারে তাঁর সরকার সব ধরনের সহযোগিতা দেবে। গতকাল সকালে বাদশাহ সৌদ রাজপ্রাসাদে সৌদি আরবের ব্যবসায়ীদের সংগঠন সৌদি চেম্বার ও রিয়াদ চেম্বার অব কমার্স নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি পারস্পরিক স্বার্থেই আপনাদেরকে বাংলাদেশে ব্যবসা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা যাতে আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় একে অন্যের হাতে হাত রেখে চলতে পারি।’ শেখ হাসিনা সৌদি বাদশাহ ও পবিত্র দুটি মসজিদের খাদেম সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের আমন্ত্রণে চার দিনের সরকারি সফরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রিয়াদ পৌঁছেন। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সৌদি উদ্যোক্তাদের দেশের বিভিন্ন উদীয়মান খাত যেমন পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিকমিউনিকেশন এবং তথ্যপ্রযুক্তি, পেট্রকেমিক্যাল, ওষুধশিল্প, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদেরকে হালকা প্রকৌশল শিল্প, ব্লু ইকোনমি, গবেষণা এবং উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, পানি এবং সমুদ্রসম্পদ ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোগত প্রকল্পে এবং সেবামূলক খাত যেমন ব্যাংকিং ও অর্থনীতি, লজিস্টিক এবং মানবসম্পদ খাতেও বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাই।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকা এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রণোদনার সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে অধিকহারে মুনাফা নিয়ে দেশে ফেরার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। যার মধ্যে রয়েছে— আইন দ্বারা সুরক্ষিত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), ট্যাক্স হলিডে, যন্ত্রাংশ আমদানিতে স্বল্প শুল্ক প্রদান, বিনা শুল্কে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির সুযোগ, রেমিট্যান্স অন রয়্যালিটি, শতভাগ ফরেন ইক্যুয়িটির নিশ্চয়তা এবং লাভ ও পুঁজিসহ বিনা বাধায় চলে যাওয়ার সুবিধা। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ এবং পানিপ্রাপ্তির সুবিধাও রয়েছে। রয়েছে ভালো ক্রেডিট রেটিং, স্বল্প ঝুঁকি ও দ্রুত প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতার সুবিধা। এসব একত্রে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ মুনাফাপ্রাপ্তির সুবিধাই নিশ্চিত করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২ হাজার একর জমি বরাদ্দ করেছি, যেগুলো বিনিয়োগকারীদের নিজস্ব চাহিদা মোতাবেক তারা ব্যবহার করতে পারবেন।’ বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিদ্যমান, যা উভয়ের বিশ্বাস, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষার একই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের ব্যবসায়িক সম্পর্কের শুরু সেই সপ্তম শতকে যখন আরবের ব্যবসায়ীরা প্রথমবারের মতো আমাদের বন্দরনগর চট্টগ্রামে আসেন।’ দুটি দেশের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেড়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আমরা এখনো ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগগুলোর পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারছি না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এখন সৌদি বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫টি প্রকল্পে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার; যার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে কৃষিভিত্তিক শিল্প, খাদ্য ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, বস্ত্র এবং তৈরি পোশাক, চামড়া, পেট্রকেমিক্যাল, প্রকৌশল ও সেবা খাত।

 গত মার্চে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্র্যাজুয়েশনপ্রাপ্তির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে তাঁর সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০০৮ সাল থেকে দেশে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়া তাঁর রূপকল্প-২০২১ ও ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধিশালী হিসেবে গড়ে তোলার পথে প্রথম ভিত্তি। ক্রয়সক্ষমতার বিচারে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত ১০ বছরে ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছে এবং এ বছর ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই দ্রুত রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক খাতে দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম সবজি উৎপানকারী, চতুর্থ বৃহৎ চাল উৎপাদনকারী ও তৃতীয় বৃহৎ মাছ উৎপাদনকারী দেশ। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তাঁর সরকার পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এক কদম অগ্রসর হয়েছে।

সর্বশেষ খবর