শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

শঙ্খ ঘোষের মৃদু রসিকতা

ইমদাদুল হক মিলন

শঙ্খ ঘোষ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। সেলিনা আপা মানে আমাদের সেলিনা হোসেন এবং আমি তখন কলকাতায়। নিউ টাউন এলাকায় বইমেলা হচ্ছে। সেলিনা আপা এবং আমি গেছি অতিথি হয়ে। অরুণিমা নামের একজন তরুণ কবি শঙ্খ ঘোষের জ্ঞানপীঠ পাওয়ার সুসংবাদটি দিলেন। গবেষক-প্রাবন্ধিক ইমানুল হক আমাদের বিশেষ পরিচিত। শঙ্খ ঘোষের খুবই অনুরাগী এবং প্রিয়ভাজন। বললেন, চলুন শঙ্খদার বাড়িতে যাই। এই সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়? শঙ্খ ঘোষ আমার অতিপ্রিয় কবি। শক্তি, সুনীল, শঙ্খ এই তিনজনের কবিতা গোগ্রাসে পড়েছি একসময়। শক্তিদার সঙ্গে তেমন পরিচয় ছিল না। সুনীলদার সঙ্গে ছিল হৃদয়ের সম্পর্ক। আজ যদি শঙ্খ ঘোষের সামনাসামনি বসে তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো যায় সেটা হবে জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। তার আগে শঙ্খদাকে দেখেছিলাম বাদল বসুর প্রয়াণের দিন। বাদলদার ফ্ল্যাটের সামনে বেশ বড় একটা আঙিনা। সেখানে বিষণ্ন মুখে একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। সেদিন পরিচিত হওয়া হয়নি। তারও আগে চুয়াত্তর সালে শঙ্খদাকে দেখেছিলাম ঢাকায়। মহিলা সমিতিতে রবীন্দ্রনাথের গানের একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল। মঞ্চে শিল্পীদের মাঝখানে বসেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি রবীন্দ্রনাথের এক একটি গান ধরে কথা বলছেন। তার পরই কেউ গেয়ে শোনাচ্ছেন সেই গান। অপূর্ব এক আয়োজন। একজন মানুষ যে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, এত স্নিগ্ধ কণ্ঠে, সেদিনই আমি যেন প্রথম তা জানলাম। বোধহয় সেই সন্ধ্যা থেকেই শঙ্খ ঘোষের ভক্ত আমি। ইমানুল হকের সঙ্গে সেলিনা আপার পেছন পেছন গেলাম শঙ্খদার বাড়িতে। হাতে করে নিয়ে গেছি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের অখণ্ড সংস্করণ। বসার ঘরে বসে আছি। আমাদের চা-সন্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শঙ্খদা একটু সময় নিচ্ছেন আসতে। কিছুদিন ধরে তাঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না। সভা-সমিতিতে গেলেও কথা বলেন খুবই কম, একটা বা দুটো। প্রথমবার এপিজে সাহিত্য উৎসবে তাঁকে দেখেছিলাম, অক্সফোর্ড বুকসের দোতলায় উৎসবের উদ্বোধক ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার তাঁদের পাশে আমি। শঙ্খদার সঙ্গে সেদিনও কথা বলা হয়নি। যা হোক কিছুক্ষণ পর বসার ঘরে এলেন শঙ্খদা। পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি, এই তাঁর সারা জীবনের পোশাক। মৃদুকণ্ঠে টুকটাক গল্প করলেন। আমি এক ফাঁকে ঢাকার সেই অনুষ্ঠানের কথা বললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দিন-তারিখসহ বলে দিলেন। এই বয়সেও বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি কবির। অসামান্য একটি সন্ধ্যা কাটালাম আমরা। মাঝখানে এক বছর গ্যাপ দিয়ে আবার গেছি এপিজে সাহিত্য উৎসবে। এ উৎসব যৌথভাবে আয়োজন করে অক্সফোর্ড বুকস ও প্রকাশন সংস্থা ‘পত্রভারতী’। পত্রভারতীর স্বত্বাধিকারী ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক। লেখক হিসেবেও জনপ্রিয়। কলকাতা পাবলিশার্স গিল্ডের কর্তাব্যক্তি এবং আমার বন্ধু। দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। শেষদিনকার সন্ধ্যায় এসেছেন শঙ্খ ঘোষ এবং সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য ভাবনা নিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বক্তৃতা করলেন। তাঁর রসালো বক্তৃতা শোনার জন্য বহু মানুষ উপস্থিত। আমাকে বসানো হয়েছে শঙ্খ ঘোষ আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মাঝখানে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় প্যান্ট আর ফতুয়া পরা। শঙ্খ ঘোষ আছেন তাঁর সারা জীবনের পোশাকে। আমি পরে আছি জিন্স আর ব্লেজার। শীতকাল আসি আসি করছে। কথার ফাঁকে খুবই আগ্রহী গলায় একসময় সঞ্জীবদা বললেন, ঢাকায় বুঝি খুব শীত পড়েছে? শুনে আমি তাঁর সূক্ষ্ম ঠাট্টাটা বুঝলাম এবং আমার খুবই গরম লেগে উঠল। মনে হলো ব্লেজারটা খুলে ফেলি। তার পরের রসিকতাটা এলো শঙ্খদার কাছ থেকে। এক ফাঁকে মঞ্চে আমি কথা বলেছি। দর্শক-শ্রোতা আমার পরিচয় পেয়ে বেশ আগ্রহী হয়েছে। মঞ্চ থেকে নেমে শঙ্খদার পাশে গিয়ে বসেছি। কিছু উৎসাহী ছেলেমেয়ে অটোগ্রাফ নিতে এসেছে। আমি অটোগ্রাফ দিচ্ছি। শঙ্খদা কিছুক্ষণ পর তাঁর স্বভাবসুলভ অতি মৃদুকণ্ঠে বললেন, মিলন, আমার অটোগ্রাফটাও দিয়ে দিও। তাঁর মুখে হাসি। আর আমি গেছি সংকুচিত হয়ে। প্রিয় পাঠক! এই মহান কবির চারটি লাইন আপনাদের জন্য উদ্ধৃত করছি—

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

তোমার জন্য গলির কোণে

ভাবি আমার মুখ দেখাব

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর