শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

চলে গেলেন ব্যান্ড কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

চলে গেলেন ব্যান্ড কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু

আঙুলের শৈল্পিক স্পর্শে রুপালি গিটারে সুরের ঝঙ্কার তুলতেন আইয়ুব বাচ্চু। গিটার আর কণ্ঠকে একাকার করে এ দেশের সংগীতের ভুবনে ঝড় তুলেছিলেন সুরের এই রাজকুমার। আর সেই গিটার নিয়েই তিনি গেয়েছিলেন ‘এই রুপালি গিটারটা ফেলে একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে’। নিজের গানের কথাকে সংগীতানুরাগীদের কাছে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়ে তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। গতকাল সকালে অসুস্থতার পর অচেতন হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এভাবেই অগণিত ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তি রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। আইয়ুব বাচ্চুর আকস্মিক মৃত্যুর খবরে সংগীতাঙ্গনসহ দেশের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। সংগীতশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, রাজনৈতিক দলের সদস্যসহ অগণিত মানুষ ছুটে যান হাসপাতালে। স্কয়ার হাসপাতালের হিমাগারে শিল্পীর মরদেহ রাখা হয়েছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। স্ত্রী, মেয়ে রাজকন্যা ও ছেলে আহনাব তাজওয়ারসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি। বর্তমানে ছেলে অস্ট্রেলিয়া ও মেয়ে কানাডায় অবস্থান করছেন। বাবার মৃত্যুর খবরে তারা দেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। স্কয়ার হাসপাতালের মেডিকেল ডিরেক্টর ডা. মির্জা নাজিম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টায় আইয়ুব বাচ্চু অসুস্থ হয়ে পড়লে ধানমন্ডির বাসা থেকে তার ড্রাইভার তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এ সময় জরুরি বিভাগের কার্ডিয়াক কনসালট্যান্ট মুনসুর মাহবুবের উপস্থিতিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে শিল্পীর হৃত্স্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে  ৯টা ৫৫ মিনিটে আমরা তাকে মৃত ঘোষণা করি।’

এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘আমরা আইয়ুব বাচ্চুকে মৃত অবস্থাতেই পাই। এর পরও আমাদের স্পেশাল টিম তাকে ফিরিয়ে আনার সব রকম চেষ্টা করে। তিনি বহুদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার হার্টে কার্ডিয়োমাইপ্যাথি ছিল। এর আগে ২০০৯ সালে তার হার্টে একটি রিং পরানো হয়।’ তিনি জানান, তিন সপ্তাহ আগে আইয়ুব বাচ্চু স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা ছিল ৩০ শতাংশ, যেখানে একজন সুস্থ মানুষের থাকে ৭০ শতাংশ। এ জন্যই বারবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো। হার্টের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তার মুখ থেকে পানির মতো ফেনা বের হচ্ছিল।

গতকাল দুুপুরে হাসপাতালেই শিল্পীর মরদেহের গোসল সম্পন্ন হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে আজ শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহে শ্রদ্ধা জানাবে সর্বস্তরের মানুষ। এরপর বাদ জুমা মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে। সেখানে প্রথম জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আই ভবনে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মরদেহ সরাসরি শিল্পীর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের নিয়ে যাওয়া হবে। পারিবারিকভাবে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, ছেলে ও মেয়ে দেশে ফেরার পর আগামীকাল শনিবার শিল্পীকে তার জন্মস্থান চট্টগ্রামের এনায়েত বাজার এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের পাশে সমাহিত করা হবে। এর আগে চট্টগ্রামে তৃতীয় ও শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবরে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে  নেমে আসে শোকের ছায়া। সংবাদ শুনে হাসপাতালে ছুটে আসেন কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী, দলছুট ব্যান্ডের বাপ্পা মজুমদার, নির্মাতা হানিফ সংকেত, অভিনেতা আফজাল হোসেন, সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ, ফাহমিদা নবী, ফকির আলমগীর, রফিকুল আলম, তপন মাহমুদ, ফুয়াদ নাসের বাবু, পার্থ বড়ুয়া, অবসকিউরের সাইদ হাসান টিপু, হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল, নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ, শিল্পী তপু, রুমি, কোনাল, মাহাদী, প্রিন্স মাহমুদ, ওয়ারফেইজের টিপু, কণা, এলিটা, অভিনেত্রী বন্যা মির্জাসহ অনেকে। গিটারে আঙুলের স্পর্শে আর অসাধারণ গায়কিতে শুধু সংগীতানুরাগীদের মাতোয়ারা করেননি, রীতিমতো এ দেশের ব্যান্ডসংগীতকে একটি শিল্পে পরিণত করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। গিটারের সুরের সঙ্গে কণ্ঠের কারুকার্যে এ দেশের অগণিত সংগীতানুরাগীদের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিলেন ব্যান্ডসংগীতের এই রাজকুমার। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে তিনি বাংলাদেশের ব্যান্ডের গানকে জনপ্রিয় করেছেন। ‘চলো বদলে যাই’, ‘রুপালি গিটার’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’সহ এ দেশের সংগীতাঙ্গনকে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য কালজয়ী গান। ১৯৭৭ সালে আইয়ুব বাচ্চুর সংগীতজীবনের শুরু। ১৯৭৮ সালে তিনি ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে যোগ দেন। তার প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। এরপর যোগ দেন সোলেস। ১৯৮০ থেকে পরবর্তী এক দশক এই ব্যান্ডে যুক্ত ছিলেন। সোল্স ছাড়ার পর ১৯৯১ সালে নিজে গঠন করেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি। প্রথমে এলআরবির পূর্ণ অর্থ ছিল লিটল রিভার ব্যান্ড। পরে এই নামে অস্ট্রেলিয়ায় আরেকটি ব্যান্ড থাকায় বদলে করা হয় লাভ রানস ব্লাইন্ড। ১৯৮৬ সালে ‘রক্তগোলাপ’ নামে তার প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশ পায়। আর এলআরবির প্রথম অ্যালবাম হলো এলআরবি (১৯৯২)। এরপর এ ব্যান্ডের সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারি মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮), যুদ্ধ (২০১২) প্রকাশ পায়। একক অ্যালবামের মধ্যে রক্তগোলাপের পর রয়েছে ময়না (১৯৮৮), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কী! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইন্সট্রুমেন্টাল, ২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)। এ ছাড়া প্রচুর মিশ্র অ্যালবামে কাজ করেছেন আইয়ুব বাচ্চু। প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। তার গাওয়া ‘আম্মাজান’ গানটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় গান।

সর্বশেষ খবর