রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

টানাটানি ছোট দল নিয়ে

মাহমুদ আজহার

টানাটানি ছোট দল নিয়ে

সম্প্রতি নুরুল আমিন বেপারী ও শাহ আহম্মেদ বাদলের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন নেতা বিকল্পধারার নতুন কমিটি ঘোষণা করেন। অব্যাহতি দেওয়া হয় অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও মাহী বি. চৌধুরীকে। বিকল্পধারার এ অংশটি যাচ্ছে বিএনপি ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে।

আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল থেকে বেরিয়ে এনডিপি ও বাংলাদেশ ন্যাপ যুক্ত হয়েছে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে। অবশ্য ভেঙেছে বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপিও। দলটি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়লে ন্যাপের একাংশের সভাপতি জেবেল রহমান গাণিকে বহিষ্কার করে ২০ দলে থেকে যায় আরেক অংশ। একই অবস্থা এনডিপিরও। প্যাড ও নামসর্বস্ব এ দলের একাংশ রয়ে গেছে ২০-দলীয় জোটে। কার্যত, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ছোট ছোট দল নিয়ে টানাটানি করছে বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। লক্ষ্য— জোট বাড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া। এ নিয়ে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। ভাঙছে জোট গড়ছে জোট। প্রধান দুই দলের জোটে থাকা অধিকাংশ দলই নাম ও প্যাডসর্বস্ব।

স্বাধীনতাবিরোধী দলের সঙ্গে কোনো ‘আপস’ নয় বলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যায় বিকল্পধারা। এখন অবশ্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সঙ্গে কোনো একসময়ে তোলা বি চৌধুরীর ছবি ও সাঈদীপুত্র মাসুদ সাঈদীর সঙ্গে মাহী বি. চৌধুরীর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিকল্পধারা মহাসচিবের বিরুদ্ধেও স্বাধীনতাবিরোধিতার অভিযোগ রয়েছে। এসব নানা প্রশ্নের মধ্যেই বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট আওয়ামী লীগের জোটে যাওয়ার গুঞ্জন রয়েছে।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজ পর্যন্ত যারা ২০-দলীয় জোট ত্যাগ করেছে, তারা নিজস্ব সিদ্ধান্তেই করেছে। এর ভালোমন্দ তাদেরই বুঝতে হবে। আমি মনে করি, এতে ২০-দলীয় জোটের কোনো ক্ষতি হবে না। ২০-দলীয় জোটকে আরও আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। নিজেদের শক্তির ওপর আস্থা রাখতে হবে। খুব দ্রুতগতিতে বিএনপিতে সংস্কার করতে হবে।’

জানা যায়, দেশে দুই শতাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত মাত্র ৩৯টি। এর অধিকাংশই একব্যক্তিনির্ভর দল। সারা দেশে এদের নেই কোনো কর্মকাণ্ড। বাসাবাড়িতে বা বাণিজ্যিক কার্যালয়কে কেউ কেউ পার্টি অফিস বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। বাকি ছোট দলগুলোর প্রায় সবই নাম ও প্যাডসর্বস্ব। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে নিবন্ধন নেই ১২টির। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটে নিবন্ধন নেই ৫টির। জাতীয় পার্টি নেতৃত্বাধীন ৫৮-দলীয় জোটে নিবন্ধন রয়েছে শুধু ৩টির। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা নেতৃত্বাধীন ৩৪-দলীয় জোটে নিবন্ধন নেই ১টিরও। ৮ দলের সমন্বয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটে নিবন্ধন রয়েছে মাত্র ২টির।

এদিকে ১৫টি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিয়ে মোর্চা করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকতে চান। এ মোর্চার কো-চেয়ারম্যান তরিকত ফেডারেশনের সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের আগে জোট-মহাজোটে আবারও ভাঙাগড়ার খেলা চলতে পারে। বিশেষ করে বিএনপি জোটে ও ফ্রন্টে এ আশঙ্কা বেশি। এর মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ ও নানা প্রলোভনে জোটের ৩-৪টি ছোট দলের বেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই জোট ও ফ্রন্টকে আস্থায় এনে আন্দোলন ও নির্বাচনমুখী করার চ্যালেঞ্জে রয়েছে বিএনপি।

জানা যায়, ভোটের আগে জোটের নেতাদের ওপর বাড়তি নজর রাখছে বিএনপি। অবশ্য আসন নিয়ে কোনো ফয়সালা না দেওয়ায় জোটের শরিক কয়েকটি দলও বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ। বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে, আসনের হিসাব-নিকাশ পরে হবে। তফসিল ঘোষণার আগে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনসহ সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনই মূল টার্গেট। এ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও আপাতত বিএনপিকে কিছুই বলছে না। তবে সময়মতো তারা ক্ষমতার ভারসাম্যের রাজনীতি ও আসন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসবে।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ৭০টি আসন ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি। এ নিয়ে সর্বোচ্চ ছাড় দিলে ১০০ আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে জোট ও ফ্রন্টকে। জোট নেতারা বলছেন, বিএনপির কাছে তাদের প্রত্যাশা অন্তত ২০০ আসন। সরাসরি না বললেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আসা দলগুলোও নিজেদের মতো করে প্রার্থী তালিকা তৈরি করে রেখেছে। তারাও চায় অন্তত ৫০টি আসন। সব মিলিয়ে বিএনপির কাছে জোট ও ফ্রন্টের চাওয়া ২৫০ আসন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সাত দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয়। আসন বণ্টন নিয়ে এখনই কিছু বলার সময় আসেনি। সময়মতো সব হবে।’

এদিকে নাম ও প্যাডসর্বস্ব দল রয়েছে আওয়ামী লীগ জোটেও। ১৪-দলীয় জোটে ১৩টি দল রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধন না থাকা দলগুলো হলো বাসদ (রেজাউর), কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণ আজাদী লীগ, মজদুর পার্টি (জাকির) ও বাংলাদেশ জাসদ (আম্বিয়া)। এ জোটে থাকা শরিক দলের একাধিক মন্ত্রীও নিজ নিজ এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন। তাদের আগামী নির্বাচনে বিজয়ী করে আনতে হলে খোদ আওয়ামী লীগকেই শক্তভাবে মাঠে নামতে হবে। ব্যক্তিইমেজ বা দলের সাংগঠনিক অবস্থা দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

জানা যায়, আওয়ামী লীগের কাছে মহাজোট শরিকদের চাওয়া ২৮০ আসন। আওয়ামী লীগ দিতে চায় সর্বোচ্চ ৭০ আসন। এ নিয়ে ভিতরে ভিতরে চলছে দরকষাকষি। কেউ কেউ মুখিয়ে আছেন জোটের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হলেও ক্ষমতায় এলে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী হওয়ার জন্য। জাতীয় পার্টি মহাজোটের শরিক। বিএনপি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টি মহাজোটে থেকেই নির্বাচন করবে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কাছে তারা চায় অন্তত ১০০ আসন এবং কমপক্ষে সাত-আট জন মন্ত্রী। ১৪-দলীয় জোটের শরিকরা চায় ১৮০ আসন। এ নিয়ে বিপাকে খোদ ক্ষমতাসীন দল।

জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা ৬৫ থেকে ৭০ আসন জোটকে ছেড়ে দেব। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা যায়, জাতীয় পার্টি নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটে দলের সংখ্যা ৫৮। সম্প্রতি ১টি দল এ জোট ছেড়ে যোগ দিয়েছে ‘ইসলামী গণতান্ত্রিক জোটে’। জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঢাউস জোট করলেও তার দল এককভাবে নির্বাচন করবে, এমন সম্ভাবনা কম। বিএনপি ভোটে অংশ নিলে দলটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করবে বলে জানিয়েছেন এরশাদ। আর বিএনপি না এলে এককভাবে ভোট করবেন। গুঞ্জন রয়েছে, ভোটের হাওয়ায় বদলে যেতে পারেন এরশাদও। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, নানা কারণে আওয়ামী লীগের সঙ্গ ত্যাগ করা এরশাদের জন্য খুবই কঠিন হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর