সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
নিরাপদ সড়ক দিবস আজ

নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন এখনো অধরা

শিমুল মাহমুদ

নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন এখনো অধরা

সড়ক-মহাসড়কে থামছে না মর্মান্তিক মৃত্যুর মিছিল। গন্তব্যে বের হয়ে কে কোথায় লাশ হয়ে ঘরে ফিরবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে নজিরবিহীন শিক্ষার্থী আন্দোলনের পরও সড়ক নিরাপত্তা এখনো অধরা রয়েছে। সড়কে এখনো চলছে রুটপারমিট ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি। ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকরা অবাধে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামছে। ঘোষণা সত্ত্বেও সড়ক-মহাসড়কে বন্ধ হয়নি তিন চাকার ছোট গাড়ি। অনেক তোড়জোড়ের পরও দেশের প্রতিটি সড়ক এখনো অরক্ষিত। প্রতিদিনের মৃত্যুফাঁদ সড়কে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়। মহাসড়কে অবাধে বাজার বসছে। চলছে উল্টোপথের গাড়ি। ফলে, নিত্যদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। এ বাস্তবতা সামনে রেখে দেশে আজ পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস-২০১৮’। ‘আইন মেনে চলব, নিরাপদ সড়ক গড়ব’— এ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজকের নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হলেও সড়ক-মহাসড়কে আইন না মানার সংস্কৃতিই সবচেয়ে বেশি জোরালো। ট্রাফিক আইন উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে যানবাহনের মালিক-চালকের পাশাপাশি পথচারীরাও পিছিয়ে নেই। এ জন্য সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার কমানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে গাড়িচালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলায় আগ্রহ অনেক কম। সম্প্রতি রাজধানীতে জেব্রা ক্রসিংগুলো নতুন করে রং করা হয়েছে। জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারে ট্রাফিক পুলিশ ও স্কাউটরা পথচারীদের উৎসাহিত করছেন। কিন্তু গাড়িচালকরা জেব্রা ক্রসিংয়ে এসেও বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালান। অনেক ক্ষেত্রে জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপরই গাড়ি রেখে যাত্রী ওঠানামা করান। নিরাপদ সড়ক দিবসে আজ বিআরটিএর পক্ষ থেকে শোভাযাত্রা বের হবে সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে। অন্যদিকে ফার্মগেট খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আলোচনা সভা শুরু হবে বেলা সাড়ে ১১টায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পর রাজধানীর সড়কে পুলিশি তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল। ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত ছিল। কিন্তু এখন পুলিশের সামনেই ভুয়া ড্রাইভাররা গাড়ি চালাচ্ছে। গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নির্ধারিত বাস স্টপেজে নামতে চান দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার কমল জোহা খান। তাতে বাধে বিপত্তি। হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে চালক আর হেলপার হামলা করে কমল জোহার ওপর। পরে নিউভিশন বাসের ড্রাইভার রাসেল গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যার হুমকিও দেয় এই যাত্রীকে। একপর্যায়ে পুলিশ সার্জেন্ট জামিল গাড়িটি থামাতে সিগন্যাল দেন। বেপরোয়া বাসচালক রাসেল পুলিশ সার্জেন্টকেও চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় বাসের স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। চালক রাসেল চেষ্টা করেও গাড়িটি স্টার্ট দিতে পারেনি। অবশেষে ধরা পড়েন চালক রাসেল। অথচ নিউভিশন বাসটির নেই রুট পারমিট, নেই চালকের লাইসেন্স। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয় ঘাতক চালক রাসেলকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া গতির ড্রাইভিং, বিপজ্জনক ওভারটেকিং ও মহাসড়কে মিশ্রগতির যানবাহনের কারণে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তারা বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলো চার লেন করে রোড ডিভাইডার দিতে পারলে বড় দুর্ঘটনা, মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো সহজ হবে। তাছাড়া মহাসড়কের হাটবাজার অপসারণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ নসিমন, করিমন, ভটভটি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে পাহারা জোরদার, চালকদের প্রশিক্ষণ, হাইওয়ে পুলিশকে সক্রিয় করাসহ সড়ক পরিবেশ উন্নত করতে না পারলে দুর্ঘটনা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এসব পূর্বশর্ত পূরণ না করে মহাসড়কগুলো শুধু চার লেন করা হলে গাড়ির গতি বাড়বে কিন্তু দুর্ঘটনা কমবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সড়ক পরিবেশও ব্যাপক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। দেশের প্রতিটি মহাসড়কের সঙ্গে শত শত লিঙ্ক রোড, ক্রসিং, হাটবাজার রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সড়কে ধান শুকানো হয়। সড়ক-মহাসড়ক ঘিরেই মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠে। মহাসড়ক নির্বিঘ্ন রাখতে কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন হয় না। দেশের সড়ক-মহাসড়কের ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেলক্রসিং রয়েছে, যেগুলোতে ওভারপাস করে যান চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্য ও দুর্ঘটনা রোধ করা যায়। প্রসঙ্গত, কুমিল্লার পদুয়ারবাজার বিশ্বরোডসংলগ্ন রেলক্রসিংয়ের ওপর একটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে চার লেন প্রকল্পের আওতায়। অথচ আরও কিছু টাকা খরচ করে অদূরেই পদুয়ারবাজার ক্রসিংকে ওভারপাসে যুক্ত করা হলে মহাসড়কের এই অংশে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন হতো। দেশের অধিকাংশ গ্রামীণ সড়কের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেন, সড়ক-মহাসড়কে মর্মান্তিক প্রাণহানির অনেক কারণের মধ্যে মূল কারণ দুটি। বেপরোয়া ড্রাইভিং ও ওভারটেকিং। তিনি বলেন, আমাদের ড্রাইভারদের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবের কারণে তারা মহাসড়কে দায়িত্বহীনভাবে বেপরোয়া গাড়ি চালায়। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের উদ্যোক্তা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে আইন মানার অভ্যাস তৈরি হয়নি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও দেখা যায় আইন ভঙ্গ করতে। এ জন্যই সড়কে বিশৃঙ্খলা কমছে না। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে আমাদের হাইওয়েগুলোকে আদর্শ হাইওয়ের আওতায় আনতে হবে। এর জন্য হাইওয়েতে ছোট গাড়ি চলাচল, মানুষ পারাপার, হাটবাজার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। ডিভাইডার দিয়ে মহাসড়কের দুই পাশ বন্ধ করে দিতে হবে।

সর্বশেষ খবর