বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আড়াইহাজারে নিহত চারজন জড়িত ছিলেন অপরাধজগতে!

রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ৪ ব্যক্তি অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন— এ রকম তথ্য বেরিয়ে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও ডাকাতি চেষ্টার অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে। জানা যায়, গত রবিবার আড়াইহাজারের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পুরিন্দা এলাকায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ফারুক, জহিরুল, খায়রুল, লুত্ফর নামে ৪ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের সবার বাড়ি পাবনা জেলায়। লাশ ছিল যেখানে, সেখান থেকে একটি শুটারগান ও একটি মাইক্রোবাসও উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা ও একটি অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করে।

তবে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে নিহতদের স্বজনরা যে অভিযোগ তুলছেন তার সঙ্গে বাস্তবতা মেলাতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। ২ জন হতদরিদ্র বেকারি শ্রমিক, বাস ও মাইক্রোবাসের চালককে পুলিশ যে হত্যা করবে তার পেছনে ‘প্রফেশনাল’ বা ‘পারসোনাল’ কারণ কী থাকতে পারে? জবাব খুঁজে ফিরছেন অভিজ্ঞ মহল। বিশেষ করে বাসচালক ফারুক পুলিশের কাছে ‘সব স্বীকার করেছেন’ মর্মে তার স্ত্রী তাসলিমা বেগম গণমাধ্যমে যে কথা বলেছেন তাতে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অপর দিকে নিহত জহিরুলের শ্বশুর লাশ শনাক্ত করতে এসে গত ২২ অক্টোবর বলেছেন, ‘বাসচালক হলেও ফারুকের অবৈধ ব্যবসা ছিল। সে ছিনতাই চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। সে নিজের শক্তি বাড়াতে ওই ছেলেগুলোকে (লিটন, সবুজ ও জহিরুল) নিজের কাছে নিয়ে এসে বিপথগামী বানিয়েছে। তারা একে অপরের আত্মীয় ছিল। ফারুক নিয়মিত বাস চালাত না। সে তিন বেলাই তিন রকমের দামি শার্টপ্যান্ট পরত যা দেখে অনেকেই সন্দেহ করত।’ এমন বক্তব্য নিয়েও চলছে নানা সমীকরণ।

জানা গেছে, গত ২০ অক্টোবর রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শীর্ষ ডাকাত সর্দার আবুল হোসেনের সঙ্গে নিহত ফারুকের সখ্য ছিল অনেক বছর ধরে। সূত্র বলছে, নিহত ২ জনই ছিলেন পেশায় বাসচালক এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কয়েক মাস আগে এই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। আবুলের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, একটি রডের ট্রাক ডাকাতির টাকার ভাগাভাগি নিয়ে আবুলের সঙ্গে ফারুকের বিরোধ দেখা দেয়। এরপর ফারুক স্থানীয় কয়েকজন যুবককে নিয়ে নিজের দল ভারী করে এবং মাসখানেক আগে তার দেশের বাড়ি থেকে কিছু ছেলেকে নিয়ে আসে। ২০ অক্টোবরের ঘটনা সম্পর্কে ওই সূত্র জানান, আমি শুনেছি ওই এলাকায় একটি ছিনতাইয়ের মালামাল নিয়ে আবুল ও ফারুক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। আবুল ওই সময় ফারুককে তার দল থেকে বের করে দেয় এবং মারধর করলে দুজনের অনুসারীদের মধ্যে গোলাগুলি হয়ে আবুল মারা যায়। আবুলের সঙ্গীরা এরপর থেকেই ফারুক ও তার সঙ্গীদের খুঁজছিল।

এদিকে ফারুকের কর্মস্থল রূপগঞ্জের ভুলতা বাসস্ট্যান্ডে গেলে এই প্রতিবেদক পেয়ে যান আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ফারুক ছিলেন অনিয়মিত বাসচালক। সব সময় দামি ব্র্যান্ডের মোবাইল ব্যবহার করতেন। প্রায় রাতেই নিজের ভাগ্নে সবুজ ও জহিরুলকে সঙ্গে নিয়ে দামি প্রাইভেট গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়তেন। আর বাস মালিকরা বলছেন, ফারুক খুব একটা বাস না চালালেও গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন বেকার ও গরিব ভাগ্নে আর জ্ঞাতি ভাইদের। ওদের রাখতেন নিজের বাসাতেই। তাদের ভরণপোষণও বহন করতেন ফারুক। ফারুকের এই বিলাসিতা দেখে প্রশ্ন জাগত তার টাকার উৎস কোথায়?

জানা গেছে, নিহত ডাকাত সর্দার আবুলও পেশায় ছিলেন বাসচালক। তার বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানাসহ জেলার বিভিন্ন থানায় প্রায় ডজন খানেক মামলা রয়েছে। প্রায় ১৫ বছর আগে ফারুক জীবিকার টানে পাবনা থেকে ঢাকায় আসেন। প্রথমে ছিলেন হেলপার এবং একসময় তিনি ড্রাইভিং শিখে চালক হয়ে যান। গত কয়েক বছর আগে আবুলের সঙ্গে ফারুকের পরিচয় হয়। দুজনের বন্ধুত্ব নিবিড় হয়ে উঠলে আবুল তার ‘প্রকত পেশা’র বিষয়টি ফারুককে জানালে ফারুক স্বেচ্ছায় আবুলের দলে যোগ দেন। এ ব্যাপারে নিহত আবুলের ভাই আবুল কালাম জানান, আমার ভাই ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে আমরা কেউই তাকে পছন্দ করতাম না। জানা গেছে, উদ্ধারকৃত ৪টি লাশের মধ্যে একটি ছিল ঘটনাস্থলে পাওয়া মাইক্রোবাস চালক লুত্ফর মোল্লার। মূলত এই লুত্ফর মোল্লার গাড়ি দিয়েই ফারুক বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ‘কাজ’ করতেন, এটা নিশ্চিত করেছেন ভুলতা এলাকার কয়েকজন পরিবহন শ্রমিক। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্রের দাবি, পুরো ঘটনাটি ডাকাতদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেরই পরিণতি যা এখন পুলিশের ওপর বর্তানোর চেষ্টা চলছে। ওই সূত্র আরও জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি নিহত ফারুক রূপগঞ্জ, সোনারগাঁসহ আশপাশের এলাকায় চিনির ট্রাক, রডের ট্রাক ডাকাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তবে নিহতদের পরিবারের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নিহত জহিরুল, সবুজ নিজ এলাকায় বেকারির শ্রমিক ছিল। ফারুকই তাদের নিয়ে এসে বিপথগামী করে।

এদিকে নিহত ফারুকের স্ত্রী তাসলিমা গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় তাদের বাড়ি থেকে ফারুক, তার ভাগ্নে জহিরুল, স্বপন ও লিটনকে তুলে নিয়ে যায়। তাসলিমা পরে জানতে পান যে, তাদের ভুলতা ফাঁড়িতে নেওয়া হয়েছে। তাসলিমার দাবি, তিনি শনিবার রাতে সেখানে ফারুকের সঙ্গে দেখা করেন এবং ফারুক তখন তাকে বলেন, ‘ওরা খুব মারছে, আমি সব স্বীকার করছি।’ ফারুক কী স্বীকার করেছেন, জানতে চাইলে তাসলিমা বলেন, তিনি তা জানেন না।

এ ব্যাপারে ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল হক জানান, যাদের নাম বলা হচ্ছে এমন কাউকে এই ফাঁড়িতে আনাই হয়নি বা এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আসামি রেজিস্টারেও এমন কারও নাম নেই। তিনি বলেন, তাসলিমা যদি বলে থাকেন যে তার স্বামী সব স্বীকার করেছে, তাহলে আমারও প্রশ্ন কী স্বীকার করেছে, আর কে-ই বা তার স্বীকারোক্তি নিয়েছে। কোনো সাধারণ বাসচালক হলে তো এমন কথা বলার নয়। মূলত, তারা হয়তো কোনো আইনি জটিলতা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এখন পুরো বিষয়টির দায় পুলিশের ওপর চাপানোর মতলবে মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর