শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
প্রার্থী নিয়ে বিপাকে জোট-মহাজোট

জিতিয়ে আনতে ঘাম ঝরাতে হবে বিএনপিকে

মাহমুদ আজহার

জিতিয়ে আনতে ঘাম ঝরাতে হবে বিএনপিকে

জাতীয় ঐক্যের অন্যতম প্রধান নেতা ও জাসদ সভাপতি আ স ম আবদুর রব ১৯৯১ সালে তৎকালীন ঢাকা-১০ আসনে (তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা) দাঁড়িয়ে জামানত হারিয়েছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ২০৮ ভোট। ঢাকা-১৬ আসনে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েও বিএনপির দুই প্রার্থী যথাক্রমে এস এ খালেক ও হারুন মোল্লার কাছে পরাজিত হন ড. কামাল হোসেন। এবার তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের দলের অন্যতম নেতা কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক। ২০০৮ সালে ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থী হয়ে তিনি পান মাত্র ২ হাজার ৭৯৭ ভোট। তারও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। শুধু এই তিন নেতাই নয়, জোট ও ফ্রন্টের সব শীর্ষ নেতারই একই অবস্থা। বিএনপি জোট-ফ্রন্ট ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে        গেলে তাদের জিতিয়ে আনতে হলে বিএনপিকেই শ্রম-ঘাম ঝরাতে হবে বেশি। জনবল দিয়ে আর্থিক সহযোগিতা করে মাঠে সক্রিয় থাকতে হবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের। আগামী নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রতীকও দেওয়া হবে অনেককেই। এ কথা জোট ও ফ্রন্ট নেতাদের একাধিকবার আকারে ইঙ্গিতে বলেছেও। তারপরও আগামী ভোটে আসন চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই জোট ও ফ্রন্টের। বিএনপির নীতি নির্ধারকরা জানান, এখনই তারা আসন ভাগাভাগিতে যাচ্ছেন না। তফসিল ঘোষণা হোক তারপর পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় এসব বিষয়ও পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি। যদি নির্বাচনের মোটামুটি অনুকূল পরিবেশ পায় তবেই নির্বাচনে যাবে তারা। অন্যথায় জোট ও ফ্রন্ট নিয়ে দাবি আদায়ে রাজপথেই থাকবে বিএনপি। অবশ্য বিএনপির একটি অংশ যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। সরকার ছাড় দিলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচনে যেতে চায় তারা। তবে আরেক পক্ষ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে। তারা বলছেন, কোনোভাবেই শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। কারণ এ নিয়ে তারা সর্বশেষ স্থানীয় সরকারের নির্বাচন এমনকি মসজিদ কমিটি গঠনের উদাহরণও সামনে তুলে আনছেন।

আসন ভাগাভাগি প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন ও বিএনপি চেয়ারপারসন মুক্তির বিষয়টিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। আমরা বৃহত্তর স্বার্থে জাতীয় ঐক্য গঠন করেছি। ২০ দলও আমাদের সঙ্গে আছে। আসন ভাগাভাগির উপযুক্ত সময় এখন আসেনি। আমরা নির্বাচনে গেলেই না আসন ভাগাভাগির প্রশ্ন আসবে।’ জোটের শরিক এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদ (অব.)  বীরবিক্রম বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে ২০ দল নির্বাচনে যাবে কি না, এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যখন নির্বাচনে যাওয়ার কথা হবে, তখন আসন নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা এ নিয়ে বিএনপিকে কোনো তালিকাও দেইনি।’ জানা যায়, ২০-দলীয় জোটের ১২টি দলই নিবন্ধনহীন। তাদের অধিকাংশই ‘এক নেতার এক দল’। ব্যক্তিগত অফিসকে কিংবা বাণিজ্যিক কার্যালয়কে ‘পার্টি অফিস’ হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন। জেলা উপজেলা এমনকি ঢাকা শহরেও কমিটি নেই অনেক দলের। ‘নাম-প্যাড সর্বস্ব’ দল হিসেবেও আখ্যা দিচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকের ব্যক্তি ইমেজও নেই। বিএনপি নেতারা বলছেন, এসব নেতার তুলনায় প্রতিটি আসনে বিএনপির অন্তত দশজন প্রার্থী অনেক বেশি যোগ্য ও দক্ষ। বিএনপি পাশে না থাকলে জামানত হারাতে হবে দুই একটি দল বাদে সবারই। বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা যতটুকু দক্ষ, ২০ দলের অনেক এমন নেতা রয়েছেন ওই ওয়ার্ড নেতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।

২০-দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামী চায় অন্তত ৬০টি আসন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও খেলাফত মজলিস চায় অন্তত ৩০টি করে আসন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ১৫টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১০টি, বিজেপি দুটি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম এবং লেবার পার্টি চায় ছয়টি করে আসন, বাংলাদেশ ন্যাপ পাঁচটি, এনডিপি দুটি, জাগপা ও এনপিপি চায় চারটি করে আসন, ডেমোক্রেটিক লীগ চায় দুটি আসন এবং সাম্যবাদী দল চায় তিনটি আসন। এ ছাড়া যুক্তফ্রন্ট বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচনে গেলে তাদেরও চাওয়া অন্তত ৫০টি আসন। সব মিলিয়ে ২৫০টিরও বেশি চায় জোট ও ফ্রন্ট। সম্প্রতি জোটের এক মিটিংয়ে জোটের শরিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা জানান, ২০-দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। এটা আমাদের চেয়ারপারসনও কারাগারে যাওয়ার আগে একাধিকবার বলেছেন। তবে জোট নেতাদের শুধু নির্বাচন নয়, আন্দোলনেরও প্রস্তুতি নিতে হবে। মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এর মধ্যে ডেমোক্রেটিক লীগের (ডিএল) সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি লড়তে চান ময়মনসিংহ-৮ আসনে। তিনি একাই নেতা ওই দলের। অফিস নেই। দলের কমিটিও নেই। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও নেই। তবে নির্বাচন ও রাজনীতির জন্য নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনেও বিশ্বাস করেন না সাইফুদ্দিন মনি। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিবন্ধন করা নির্বাচনের শর্ত হতে পারে না। এটা রাজনীতিকে একটি শর্তে বেঁধে ফেলারই নামান্তর। আমি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে জোটের প্রার্থী হতে চাই। আমার দলের আরেকজন নেতা আছেন তিনি সিরাজগঞ্জে একটি আসন চান। তবে ওই নেতার নাম এখনই বলা যাবে না।’ সাম্যবাদী দলের (একাংশ) প্রধান কমরেড সাঈদ আহমদ। দলের সবই তিনি। গুলিস্তান খদ্দের মার্কেটে অফিস থাকার কথা বললেও কার্যত সেটা নিজের বাণিজ্যিক কার্যালয়। সারা দেশে এমনকি ঢাকায়ও কমিটি নেই। তারপরও নির্বাচনের মাঠে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ২০ দলের এই নেতা। তিনি নারায়নগঞ্জ-৫ আসনে লড়তে চান। তার দল থেকে প্রথমে সাতটি আসন চাওয়া হয়। সর্বশেষ তিনটিতেই সন্তুষ্ট থাকতে চায় সাম্যবাদী দল। এ নিয়ে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে সাঈদ আহমদের কথাও হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাঈদ আহমদ বলেন, নারায়ণগঞ্জ সদর থেকে লড়তে চাই। পোস্টারও সাঁটিয়েছি। বিএনপিও সবুজ সংকেত দিয়েছে। মাঝে মধ্যে এলাকায়ও যাই। বিএনপি নেতারা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া এখনো অনিশ্চিত। দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই আন্দোলনে জোটের শরিকদের তেমন কোনো গরজ নেই। তারা সবাই এখন নিজেদের আসনের নিশ্চয়তা চায়। তবে জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বিএনপির সঙ্গে আসন নিয়ে কথা বলতে চাইলে বিষয়টিকে তারা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। দীর্ঘ ১০ বছর ধরেই শুধু নানাবিধ আশ্বাসেই কাটাতে হচ্ছে শরিকদের। বিএনপির এই দুঃসময়ে জোটের কোনো শরিক দল ছেড়ে যায়নি। তা ছাড়া ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে অনেকাংশে বিএনপির নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো চাপিয়ে দেওয়া হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও অনেকটাই চাপিয়ে দেওয়া। তারপরও জোট এসব সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে। অবশ্য এ নিয়ে বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ কয়েকটি শরিক দল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য জানান, জোটের শরিক দলগুলোর কাকে কয়টা আসন দেওয়া হবে, তার একটা প্রাথমিক হিসাব-নিকাশ ২০১৪ সাল থেকে নীতিনির্ধারকদের কাছে রয়েছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তাই আরও কিছু আসন ছেড়ে দিতে হবে ফ্রন্টকে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের ব্যাপারে বিএনপি উদার থাকবে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে গেলে জোট ও ফ্রন্টকে সর্বোচ্চ আসন ছাড় দেওয়ার নীতিতে থাকবে বিএনপি।

সর্বশেষ খবর