শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু

ইমদাদুল হক মিলন

প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু

ওই তো কফিনের ভিতর শুয়ে আছে আইয়ুব বাচ্চু! শহীদ মিনারে হাজার হাজার মানুষ। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে কফিন। টিভি ও সংবাদপত্রের ক্যামেরা চারদিকে। পুলিশ-র‌্যাব জনতার ভিড় সামলাচ্ছে। অক্টোবরের  রোদে শহীদ মিনারের বাইরে লাইন ধরে আছে কয়েক হাজার মানুষ। তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। সাধারণ মানুষও আছে অনেক। তাদের প্রিয়তম গায়ককে শেষ দেখা দেখতে এসেছে, শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। প্রিয় মানুষের মৃতমুখ আমি সহ্য করতে পারি না। কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছি ঠিকই একবারও বাচ্চুর মুখের দিকে তাকাইনি। আমার পাশে এবং সামনে দাঁড়িয়ে আছে কত প্রিয়মুখ। কতজনের চোখের পানিতে গাল ভেসে যাচ্ছে। এভাবে কেন চলে গেল বাচ্চু! আগের দিন অফিসে এসে খবরটা পেলাম। প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। বাচ্চু আমাদের চেয়ে কত ছোট। কী এমন হয়েছিল তাঁর যে এভাবে চলে গেল! বিস্তারিত জেনে বুকটা হু হু করে উঠল। স্কয়ার হসপিটাল তখন আমাদের সংস্কৃতি জগতের লোকে লোকারণ্য। প্রতিটি টেলিভিশনের পর্দার স্ক্রলে চলছে এই মর্মবিদারক সংবাদ। আমি পাথর হয়ে রইলাম। তার আগের দিন খবর পেয়েছি কলকাতার কবি এবং আনন্দবাজার গ্রুপের ম্যাগাজিনগুলোর এক্সিকিউটিভ এডিটর পৌলোমি সেনগুপ্ত চলে গেছেন। বয়স হয়েছিল ৪৯। পৌলোমির কবিতা আমি খুব পছন্দ করতাম। কলকাতায় গেলে দেখা হতো, আড্ডা হতো। প্রিয় মানুষরা এভাবে বিদায় নিচ্ছেন কেন?

বাচ্চুর কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে কত দিনকার কত স্মৃতি মনে আসে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাচ্চুকে চিনি। বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছিল আমাদের সংগীত জগৎ। ব্যান্ড সংগীতকে নিয়ে যাচ্ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তপন ও বিশ্বজিৎ গান গেয়ে মুগ্ধ করছিল যুব শ্রেণিকে আর গিটারে বাচ্চু মুগ্ধ করে যাচ্ছিল ওই যুব শ্রেণিকেই। সেই যে যাত্রা শুরু বাচ্চুর, তার পরের তিনটি প্রজন্মকে যেমন মুগ্ধ করেছে গিটারে, তেমনি মুগ্ধ করেছে কণ্ঠের জাদুতে। বাচ্চুর কনসার্ট মানেই লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর সমাবেশ। একদিকে চলছে বাচ্চুর গিটার, আরেক দিকে উদাত্ত কণ্ঠ। সারা পৃথিবীর বাঙালি মুগ্ধ হয়ে থাকল। এত বড় মঞ্চ ফেলে এভাবে কেন চলে গেল বাচ্চু?

কলকাতায় জিবাংলায় সারেগামাপার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নোবেল নামের ছেলেটি জেমসের গান গেয়ে মাতিয়ে দিল। উপস্থাপক যিশু সেনগুপ্ত নোবেলকে অনুরোধ করলেন আইয়ুব বাচ্চুর একটি গান শোনাতে। সেই গান শুনেও বিচারকরা মুগ্ধ। বাচ্চু চলে যাওয়ার পর আরেক অনুষ্ঠানে নোবেল গাইল বাচ্চুর গান। এই গান গেয়েও সে মাতিয়ে দিল সবাইকে। স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘মহান শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর প্রয়াণে আমরা শোকাহত’। বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের এভাবে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেল বাচ্চু! নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমি একটা সিরিজ নাটক করেছিলাম। নিজের লেখা, নিজের প্রযোজনা এবং নিজের ডিরেকশন। অভিনয়ে গোলাম মুস্তাফা, তৌকীর, শমী, চিত্রলেখা গুহ। শমী তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেছিল। চিত্রলেখা গুহ হয়েছিলেন শমীর মা, গোলাম মুস্তাফার স্ত্রী। সুবর্ণা মুস্তাফা আমার বন্ধু। এ জন্য গোলাম মুস্তাফাকে আঙ্কেল ডাকতাম। শুটিংয়ের সময় একদিন তিনি মজা করে বললেন, মিলন, চিত্রলেখাকে তুমি আমার স্ত্রী বানিয়েছ, ও তো সুবর্ণার চেয়েও ছোট!

নাটকটির নাম ছিল ‘যুবরাজ’। এই নাটকের মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে আইয়ুব বাচ্চুকে পছন্দ করলাম। তার আগে বাচ্চু কোনো নাটকের মিউজিক করেনি। আমার প্রস্তাবে কী যে খুশি হলো! সময় ধরে ধরে অতিযত্নে প্রতিটি পর্বের মিউজিক করল। কী অসামান্য কাজ! তার গিটারের ঝংকার এখনো হৃদয়ে লেগে আছে। আমার ইচ্ছা, নাটকের এক জায়গায় শচীন দেববর্মণের একটা গানের কয়েকটা লাইন ব্যবহার করব। বাচ্চুকে বললাম, তুমিই গেয়ে দাও। বাচ্চু বলল, না মিলন ভাই, আমার সঙ্গে একটা ছেলে আছে, ওকে দিয়ে গাওয়াব। ওর গলাটা ভারি সুন্দর। সেই ছেলেটির নাম এস আই টুটুল। আমার নাটকে টুটুলকে দিয়ে গান গাওয়াল বাচ্চু। তারপর ধীরে ধীরে টুটুল এস আই টুটুল হয়ে উঠল। হুমায়ূন আহমেদ টুটুলকে পৌঁছে দিলেন খ্যাতির শীর্ষে। বাচ্চুর কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে এসব কথা মনে পড়ে। চাইলে সেদিন নিজেই শচীন দেবের গানটা গাইতে পারত বাচ্চু। তা না করে একজন নতুন শিল্পীকে জায়গা করে দিল। বাচ্চু এ রকমই ছিল। ভালোবাসায় বন্ধুত্বে আবেগে অনুরাগে বাচ্চুর তুলনা ছিল সে নিজে। বাচ্চু গেয়েছিল ‘এই রুপালি গিটার ফেলে, একদিন চলে যাব দূরে বহু দূরে।’ সেই দিন যে এত দ্রুত চলে আসবে, কে ভেবেছিল? সবাই সবকিছু পিছনে ফেলে চলে যায়। দুঃখ একটাই, বাচ্চু গেল কম বয়সে। অসময়ে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর