শনিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দিনে তারা পিকআপ চালক রাতে ভয়ঙ্কর ডাকাত

আট বছর ধরে ঢাকায় সক্রিয় ১০ দল, সিন্ডিকেটে আছেন ব্যবসায়ীরা

মাহবুব মমতাজী

প্রায় ৩ বছর আগে রাজধানীর মগবাজারে চালবোঝাই একটি ট্রাক ছিনতাই হয়। এ ঘটনায় রমনা থানায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেমে পুলিশ ভয়ঙ্কর ডাকাত দলের একটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পান। যাদের কেউ দিনের বেলায় পিকআপ ভ্যান চালায় আবার কেউ কারওয়ানবাজারের শ্রমিক। কিন্তু দিন শেষে রাত নামলেই এরা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর ডাকাত। তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিরিয়াস ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিট পুলিশ সূত্র জানায়, এই সিন্ডিকেটে দেশের বিভিন্ন এলাকার কিছু ব্যবসায়ীও রয়েছেন। যারা লুটের পণ্য ক্রয় করে থাকেন। ইতিমধ্যে এই সিন্ডিকেটের ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলো— মেহেদি হাসান ওরফে মৃধা, কেরামত, শমসের ডাকাত, নুরুজ্জামান ওরফে নজু ও কামরুজ্জামান। এদের মধ্যে মেহেদি গত মাসে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তার দেওয়া  জবানবন্দিতেই বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দিনে পিকআপ ভ্যানচালক এবং কারওয়ান বাজারের শ্রমিক। অথচ রাতে তারা ভয়ঙ্কর ডাকাত দলের সদস্য। সংঘবদ্ধ এই দলের মোট সদস্য অন্তত ১০ জন। পণ্যবাহী চালের ট্রাক, কখনো মসলার আবার কখনো গরু ভর্তি ট্রাক অস্ত্রের মুখে লুটে নিত এরা। ডাকাতি করা তাদের মালামাল পানির দামে কিনে নিত কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এই অসাধু ব্যবসায়ীর একজন মাদারীপুরের চাল ব্যবসায়ী কেরামত। তিনি ডাকাত দলের সদস্য সোহেলের চাচাতো ভাই। ডাকাতির চাল বিক্রি করে এখন এলাকায় বড় ব্যবসায়ী বনে গিয়েছে কেরামত। ডিবি পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের সহকারী কমিশনার (এসি) নাদিয়া ফারজানা এ প্রতিবেদককে জানান, সংঘবদ্ধ এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতে পণ্যবাহী ট্রাকে ডাকাতি করে আসছিল। সম্প্রতি এই ডাকাত দলের পাঁচ সদস্য গ্রেফতার হয়। এদের অন্য সহযোগীদেরও শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পুরো ঘটনা স্বীকার করলেও আদালতে গিয়ে কিছুই বলত না। এতে মামলা তদন্ত শেষ করতে বেগ পেতে হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ মে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে বাবুবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে আসা নিউ হাসিব আটো রাইস মিলের একটি চালবোঝাই ট্রাক মগবাজার থেকে ছিনিয়ে নেয় ডাকাতরা। পরের দিন ওই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার আজহার ইসলাম একটি মামলা করেন। মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ৮ বছর ধরে রাজধানীতে সক্রিয় এই ডাকাত দল। আবদুল্লাহ নামের এক দুুর্ধর্ষ ডাকাত ছিল তাদের দলনেতা। তার নেতৃত্বে রাজধানীর কারওয়ানবাজার, মগবাজার, মতিঝিল, লালবাগ এলাকায় পণ্যবাহী ট্রাকে ডাকাতি হতো। এই সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় ট্রাকভর্তি চামড়া ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় একটি মামলাও রয়েছে। মতিঝিল থানায় রয়েছে আরেকটি ডাকাতির মামলা। রমনা থানার মামলায় ২০১৬ সালে গ্রেফতারের পর তিন দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেও মেহেদির কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পরে চতুর্থ দফা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে সে চালের ট্রাক ডাকাতির ঘটনা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর কেরামতকে মাদারীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। আদালত সূত্র জানায়, মেহেদি তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, ঘটনার দিন তারা ১০ জন একটি পিকআপ নিয়ে ঢাকার রাস্তায় ঘুরতে থাকে। আনুমানিক রাত আড়াইটার দিকে মগবাজার এলাকায় একটি চালবোঝাই ট্রাককে ব্যারিকেট দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। পরে ট্রাকের চালক শাহজাহান ও হেলপারকে মারধর করে ট্রাকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া হয়। তাদের সঙ্গে থাকা একজন ট্রাক চালিয়ে খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে নিয়ে যায়। পরে পিকআপে করে চালক-হেলপারকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরিয়ে তেজগাঁও বিজি প্রেস স্টাফ কলোনির সামনে হাত-পা বেঁধে ফেলে দেয়। এ সময় সোহেল ফোন দিয়ে বলে রাতের মধ্যেই চাল বিক্রি করতে হবে। ঘটনার দিন রাতেই তার চাচাতো ভাই কেরামতের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫ লাখ টাকার চাল ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে তারা। পরে কেরামত চাল মাদারীপুর নিয়ে যায়। তাদের এই চক্রটির সঙ্গে অনেক ব্যবসায়ীর যোগাযোগ ও সখ্য রয়েছে। তারা অল্প দামে ডাকাত দলের কাছ থেকে মালামাল কিনে রমরমা বাণিজ্য করে আসছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ডাকাত দলের সঙ্গে সখ্য রয়েছে এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম পাওয়া গেছে। যাচাই-বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর