শনিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণভবনে সেই সাড়ে তিন ঘণ্টা

প্রধানমন্ত্রী একজন সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নাম জানতে চাইলে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা ছিলেন চুপ

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

গণভবনে সেই সাড়ে তিন ঘণ্টা

বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে তিন ঘণ্টার সেই সংলাপে যত কথা হয়েছে তার পুরোটাই অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার অন্যতম একটি দফা হলো তফসিলের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। এ নিয়ে সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের কাছে একজন গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির নাম চান। তিনি বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করব, আপনারা সবাই মিলে একজন সর্বজনগ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ ব্যক্তির নাম বলেন।’ এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা কথা বলেননি। চুপ ছিলেন। এমনকি ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনিও কিছু বলেননি। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য জানান।এভাবেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হয়ে গণভবনে জমে ওঠে সাড়ে তিন ঘণ্টার সংলাপ। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি ছাড়াও সবাই খোলামনে কথা বলেন সংলাপে। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে শেষ হয় বহুল আলোচিত এ সংলাপ। এর মধ্যেই চলে হালকা নাশতাসহ রাতের খাবার। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের পক্ষে নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে ছিলেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। দুই অংশের মোট ৪৩ জন নেতা এতে অংশ নেন।

সংলাপের শুরুতেই উপস্থিত সবাইকে গণভবনে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণভবন জনগণের ভবন। এ ভবনে আপনারা এসেছেন। গণভবন ধন্য হয়েছে। আপনারা সবাই দেশের স্বনামধন্য নাগরিক।’ তিনি বলেন, ‘এ দেশটা আমাদের। সবাই মিলেই দেশটাকে গড়তে হবে। আমরা প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। কী করতে পেরেছি, উন্নতি করতে পেরেছি কিনা সে বিচারের দায়িত্ব আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম।’ এরপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এতে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন। তিনি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি করেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা ও ১১টি লক্ষ্য পাঠ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর একে একে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বক্তব্য দিতে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী ধৈর্যসহকারে প্রত্যেকের বক্তব্য শোনেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের বক্তব্যের পর ১৪-দলীয় জোট নেতারাও বক্তব্য দেন। সবশেষে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। এর মাঝে দাবি-দাওয়া নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তিও দেয় দুই পক্ষই। নিরপেক্ষ সরকারের দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা তফসিল ঘোষণার আগেই সংসদ ভেঙে দিতে বলছেন। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলছেন। ভালো কথা। কল্লাই (মাথা) যদি না থাকে তাহলে কার সঙ্গে আলোচনা? আলোচনা করে লাভ কী?’ ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আপনারা যারা এখানে আছেন, আমরাও আছি, কেউ কি একজন সর্বজনগ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ ব্যক্তির নাম বলতে পারবেন? খুঁজে পাবেন?’ এ সময় উপস্থিত সব নেতা নীরব ছিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর প্রধানমন্ত্রী আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি বলতে পারবেন?’ এ সময় অনেকেই মাথা নিচু করে ‘না-না’ করেন। সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও মির্জা আব্বাসকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা যে অনির্বাচিত সরকার চাচ্ছেন ১/১১-এর নির্দলীয় সরকার কী করেছিল মনে নেই? আপনাদের তো গ্রেফতার করেছিল। আমার পাশে (ডানে ওবায়দুল কাদের, বাঁয়ে শেখ সেলিমের দিকে তাকিয়ে) যারা আছেন তাদেরও গ্রেফতার, নির্যাতন করেছিল। সেগুলো কি ভুলে গেছেন?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেই বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমানের অসুস্থ স্ত্রী ও ইকবাল হাসান মাহমুদের অবিবাহিত মেয়েকে যখন গ্রেফতার করে তখন আমিই প্রথম প্রতিবাদ করেছি। আপনারা তো অনেকেই তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়েছিলেন। নিরপেক্ষ সরকারের কাজ সুখকর ছিল না।’

‘এই সংসদের ১৫৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত’— ড. কামাল হোসেনের এ কথার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনি তো ’৭২-এর সংবিধান রচনা করেছেন। আপনি লিখিত বক্তব্যে বললেন যে, এই সংসদে ১৫৩ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে কোনো প্রার্থী না থাকলে আমাদের কী করার আছে? তা ছাড়া আপনি নিজেও তো বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন কি আপনি পদত্যাগ করেছিলেন?’ এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর নানা উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন ড. কামাল হোসেন। আগামীতেও ছোট পরিসরে আলোচনার দাবি করেন ড. কামাল হোসেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে আমার দরজা সব সময় খোলা। যে কোনো সময় আলোচনা হতে পারে।’

সাত দফা ও ১১ লক্ষ্য ছাড়াও আলোচনায় স্থান পায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে কথা বলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আমরা যদি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিই তাহলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এখানে আমাদের করার কিছু নেই।’ এ প্রসঙ্গে জমিরউদ্দিন সরকার আরও বলেন, ‘আপিলে গেলে জামিন হতে পারে। আপিলে যেন জামিন আপত্তি না করা হয়।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ মামলা তো আমি করিনি। এটি করেছে এক-এগারোর সরকার। আমার কী করার আছে? একজনের জন্য একরকম আইন, আরেকজনের জন্য আরেকরকম আইন— এটি তো হতে পারে না। আর এখানে রাজনৈতিক কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই।’ এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘তাঁকে (খালেদা জিয়া) কারাগারে রেখে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ এর জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি আপনাদের দলীয় বিষয়। আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আপনারা অংশ নেবেন তা আমরা আশা করি।’ জানা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদান এবং সাত দিন আগে সেনাবাহিনী নামানোর দাবি করেন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও বলেন, ‘সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলছেন? আপনারা কি ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা ভুলে গেছেন?’ এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ড. কামাল হোসেন নিজেও ১৯৭৩ সাল থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছেন। এ পর্যন্ত ২০০১ সালের প্রশ্নবিদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো ভোটে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়নি।’ নির্বাচনের আগে ‘রাজবন্দী’দের মুক্তির দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনারা নামের তালিকা দিন, ধরন দেখলেই বুঝব কোনটা রাজনৈতিক মামলা। যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপি আমলে প্রধানমন্ত্রীর নামে ১৬টি মামলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধেও ১৬টি মামলা হয়েছিল। আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। প্রতিটি মামলা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত হয়েছিল। সত্যতা না পাওয়ায় তা খারিজ করা হয়েছে।’

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল ও ব্যারিস্টার মওদুদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘আপনারা রাজনৈতিক মামলার কথা বলছেন। গ্রেফতার ও নির্যাতনের কথা বলছেন। আমি তো কাউকে খুন করিনি! বিএনপি সরকার আমলে তারেক রহমান ও ওই সরকারের মন্ত্রীরা মিলে আমাকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে?’ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর গুলশানে গিয়ে ফিরে আসার ঘটনা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার মওদুদকে প্রশ্ন করেন, ‘খালেদা জিয়ার ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর সহানুভূতি জানাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সে সময় আপনি (মওদুদ আহমদ) তো ছিলেন।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পাল্টা জবাবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বাসাটির দোতলায় ছিলেন বলে জানালে ক্ষুব্ধ শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাহলে কি দোতলায় বসে থেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন আমাকে ঢুকতে দেওয়া না হয়?’ ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করার দাবি করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশ অনেক এগিয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আর ইভিএম উন্নত প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তির অপব্যবহারের সুযোগ নেই। কারও ভোট কেউ দিতে পারবে না। আর গণনাও খুব কম সময়ে করা যায়। সে কারণে আমরা সীমিত আকারে ইভিএম চাই।’ ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, সুব্রত চৌধুরীসহ আলোচনায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ নেতাই বক্তৃতা করেন। চুপচাপ ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি কোনো কথা বলছিলেন না। সবাই বক্তব্য দেওয়ার পর ডা. জাফরুল্লাহকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবাই তো অনেক কথাই বললেন, আপনি কিছু বলবেন না? আপনি কিছু বলুন।’ এ সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার সপ্তম দফা থেকে তার বক্তব্য শুরু করেন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্বস্ত করেন, ‘কোনো রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হবে না। পুলিশ কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করবে না। আপনারা স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ করতে পারবেন। তবে মানুষের যেন দুর্ভোগ না হয় সে বিষয়টি নজর রাখতে হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি কর্নার করে দেওয়া হবে। যার যত খুশি সভাসমাবেশ করবে। তবে কিছু মেইনটেন্যান্স খরচ দিতে হবে।’ এ সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি করেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে কড়া ভাষায় জবাব দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সেলিম বলেন, ‘সংসদ ভেঙে দিলে প্রধানমন্ত্রী থাকবে না, তাহলে দেশ চালাবেন কে?’ এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘প্রতিবারই নির্বাচনের জন্য আলোচনার দরকার হবে কেন, এটা নিয়ে স্থায়ী সমাধানের দিকে যাওয়া দরকার।’ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এর উত্তরে বলেন, ‘সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার কীভাবে গঠন করা যাবে, এর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রয়োজনে একটি কমিটি করে দিন। আমরা ড. শাহদীন মালিক ও ড. আসিফ নজরুলকে দিই, আপনারা কাদের দেবেন, দিয়ে একটা সমাধান করা যেতে পারে।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিন, আপনি নোবেল প্রাইজ পাবেন।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধানকে নিয়ে দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনি তো যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, খালেদা জিয়া থাকলে তো জেলেই যেতেন।’ এ সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মাননীয় নেত্রী! আমি সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চেয়েছি।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনি তো আরও বড় অপরাধ করেছেন।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ৩১ একর জমি দিয়েছিলেন। আপনিও দিয়েছেন ১৪ একর জমি। কিন্তু আপনার বাবার দেওয়া জমি ব্যবহার করতে পারলেও আপনার দেওয়া জমি কিন্তু এখনো দখলে পাইনি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনিই বললেন, আব্বার কাছ থেকে পেয়েছেন, আমিও দিয়েছি। অথচ টেলিভিশনে গিয়ে আপনি আমার ও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন!’

বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় গণস্বাস্থ্যের ক্যান্সার হাসপাতাল উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময় চান ডা. জাফরুল্লাহ। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি উদ্বোধন করতে যেতে পারব না। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে।’ এ সময় গণস্বাস্থ্যের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারসহ বেশকিছু আবেদনপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মাহমুদুর রহমান মান্না সংলাপে দুটো বিষয় উত্থাপন করেন। দুটো বিষয়ই আওয়ামী লীগ আমলে নেয়নি। একটি হচ্ছে যে সংলাপ শুরু হয়েছে, পরিস্থিতি নিষ্পত্তির আগে তা চালু রাখা। দ্বিতীয়ত, সংলাপ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করা। মান্না খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলেন। নাগরিক ঐক্যের যশোরের এক নেতাকে গ্রেফতার করার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মান্না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কী তথ্য আছে, আমি জানি না। তাদের বিষয়টি তারাই দেখবে।’ মান্না তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তফসিল পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। এটা আমার কাজ নয়, নির্বাচন কমিশনের কাজ।’ বক্তৃতার একপর্যায়ে ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে কথা শেষ করেন। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীতে কোথাও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নেই। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তারাই নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকায় থাকে। ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু ভোটের নিশ্চয়তা দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আগামী ভোট সুষ্ঠু হবে, কোনো ছলচাতুরী হবে না। আপনারা সবাই অংশ নিন। আপনারা ভোটে অংশ নিলে নির্বাচন আরও সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে।’ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘একবার সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মাঠে পাঠানো হয়েছিল। তখন কী পরিমাণ রাজনীতিবিদকে পেটানো হয়েছে তা সবাই জানেন। এটা আপনারা ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি। আমার ওপর কী পরিমাণ নির্যাতন চালানো হয়েছে তা আমি জানি।’ সংলাপ শেষে বেরিয়ে এসে বিএনপির এক নেতা ড. কামাল হোসেনের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি একবারও বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির কথাটি বলেননি।’ ওই সময় পাশে থাকা গণফোরামের এক নেতা বলেন, ‘আপনাদের যদি সামর্থ্য থাকে, তাহলে আন্দোলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করুন।’

জাসদ নেতাদের বাহাস : সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অন্য নেতারা একে অন্যের বিষোদগার করেন। সংলাপে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘আপনারা যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছেন। জ্বালাও-পোড়াও করে মানুষ হত্যা করেছেন। সংলাপে আপনাদের কোনো দাবি মানা হবে না। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।’ জবাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আমরা এসেছিলাম আলোচনা করতে। আলোচনার মাধ্যমে একটি সহজ সমাধান করতে। কিন্তু এখানে কারও কারও কথা যেটা আওয়ামী লীগের নয়। এভাবে আলোচনা হলে সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়, সমাধান আসবে না। সংঘাতের দিকেই যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখানে “দায়ের চেয়ে আছার”ই বড় হয়ে যাচ্ছে।’ এ সময় তিনি হাত দিয়ে দেখান। এ প্রসঙ্গে জেএসডি সাধারণ সম্পাদক মালেক রতনও কথা বলেন। তিনিও রবের সুরে কথা বলেন। রবের কথা শেষ হওয়ার মুহূর্তেই তার স্ত্রী ও জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব বলেন, ‘আমার কিছু কথা আছে।’ উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবশ্যই বলুন। আমি নারীর ক্ষমতায় বিশ্বাসী। নারীদের কল্যাণে এত কিছু করলাম, আর আপনি কথা বলবেন না?’ এ সময় তানিয়া রব একাদশ সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে সরকারের পদক্ষেপ কামনা করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নগুলো তুলে ধরে ব্যাপক প্রশংসা করেন। সবশেষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক দেখতে চান বলে জানান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনে আসুন। দূরে থাকলে কীভাবে বুঝবেন?’ জবাবে বিএনপি নেতারা বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হবে?’ এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব দলকেই নির্বাচনে চাই। সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমি চাই।’

সর্বশেষ খবর