মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

টার্নিং পয়েন্টে রাজনীতি

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের ছোট পরিসরে সংলাপ বুধবার, যোগ দিলেন বঙ্গবীর ঢাকায় বড় শোডাউন আজ, সংবিধানের মধ্যেই দুই পক্ষ ছাড় দিতে চায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দফা সংলাপ আগামীকাল বুধবার। ছোট পরিসরে অনুষ্ঠেয় এই সংলাপের প্রস্তুতি সারছেন দুই জোটের শীর্ষ নেতারা। দুই পক্ষই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগোচ্ছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের পরামর্শ নিয়েছেন। অন্যদিকে সংবিধানের মধ্যে থেকে কতটুকু ছাড় দেওয়া যায়— সে বিষয়ে হোমওয়ার্ক করছেন ক্ষমতাসীনরা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য সংবিধানের ভিতরে থেকে যতটা সম্ভব নমনীয়তা দেখাবে সরকার।

দীর্ঘ অপেক্ষার পর সবকিছু ছাপিয়ে গতকাল দিনভর আলোচনায় ছিল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান। তাকে নিয়ে আজ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করবে ঐক্যফ্রন্ট। জনসভায় ব্যাপক লোক সমাগমের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অন্তত ৫ লাখ লোক সমাগম হবে। ঢাকার এই জনসভায় তারা সরকারকে একটি আলটিমেটামও দিতে চায়। সংলাপ ফলপ্রসূ না হলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেওয়া হবে জনসভা থেকে।  এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সাত দফা দাবি নিয়ে এগোলেও শেষ পর্যন্ত তারাও ছাড় দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। তফসিলের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে সর্বদলীয় নির্বাচনকালীন সরকার হলেও মেনে নিতে পারে ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেক্ষেত্রে দু-একটি দাবি ছেড়েও দিতে পারে দলটি। সবাই এখন সংবিধানের মধ্যে থেকেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার পথ খুঁজছে। তবে ভোটের তফসিল আরও কিছুদিন পেছানোর জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। গতকাল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সিইসিসহ অন্য কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করে এ অনুরোধ জানান।  

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আগামী ৮ তারিখ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে কয়েক দিন রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। এই সময়ের মধ্যেই নির্ধারণ হবে রাজনীতির উত্তাপ আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে নাকি রাজপথে? দুই পক্ষই চায় আলোচনার মাধ্যমে একটা সঠিক সমাধান। সরকারের কাছে দাবি আদায় এবং সারা দেশে জনসমর্থন আদায় করা— এ দুটি চ্যালেঞ্জ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সামনে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জানায়, আজ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভার পর ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে ৯ নভেম্বর জনসভা করা হবে। এ ছাড়া বরিশাল, রংপুর ও খুলনায়ও জনসভা করার চিন্তাভাবনা করছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অন্যদিকে সরকার সবকিছু খুব সতর্কতার সঙ্গেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শোডাউন আজ : নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আজ ঢাকায় শেষ জনসভা করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা করতে চায় তারা। জনসভার প্রস্তুতি নিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট দফায় দফায় মিটিং করেছে। জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। প্রধান অতিথি থাকবেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এই জনসভায় জনস্রোত নামানোর পরিকল্পনা নিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। জনসভা থেকে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ঘোষণা করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গতকাল রাতে জোটের মুখপাত্র বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন। আজ (মঙ্গলবার) বেলা ২টা থেকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। রাত ৯টার দিকে রাজধানীর মতিঝিলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের চেম্বারে ওই ব্রিফ হয়। এতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ঐক্যফ্রন্টের বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপের বিষয়বস্তু কী হবে সে প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, এ বিষয়টিও কাল চূড়ান্ত হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রথম দফার সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সংলাপে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক মামলা হবে না। কিন্তু এখনো তা চলছে। নেতা-কর্মীদের গণগ্রেফতার করা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে, গত রাতে ৬০ ফুট বাই ৪০ ফুট মঞ্চ তৈরি করা হয়। রাতেই মঞ্চ পরিদর্শন করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম। এদিকে জনসভাকে ঘিরে নতুন করে গ্রেফতার-হয়রানি চলছে বলে ঐক্যফ্রন্ট অভিযোগ করেছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা জানিয়েছেন, ২৪ শর্তে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জনসভায় ঐক্যফ্রন্টের সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি ২০-দলীয় জোটসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য রাখবেন। জনসভায় গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, মানিকগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকেও নেতা-কর্মীদের জনসভায় যোগ দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে জনসভা করা হলেও কার্যত বিএনপির নেতা-কর্মীদের ঢল নামবে জনসভায়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এ জনসভা ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জনসভা সফলের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। রাতে জনসভা ভেন্যু পরিদর্শন শেষে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, জনসভাকে জনসে াতে পরিণত করা হবে ইনশাআল্লাহ। এদিকে জনসভা সফল করতে গত কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র নেতাদের বৈঠক হয়।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী : গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদানের ঘোষণা দেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। এ সময় তিনি বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য আজ (সোমবার) এই মুহূর্ত থেকে আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলাম। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে থেকে ড. কামাল হোসেন আমাদের সব রকমের আইনি সহায়তা দেবেন। আর আমরা সবাই মিলে দেশের জন্য যুদ্ধ করব।’ তিনি বলেন, ‘টিক্কা খানের সঙ্গে যদি আমরা জিততে পারি, তাহলে আজকের এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও আমরা জিততে পারব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর যোগ দেওয়ার ঘোষণার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তাকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, মো. শাহজাহান, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ চালানোর কারণে দেশের আজ এ পরিস্থিতি হয়েছে। এরপরও তাকে ধন্যবাদ জানাই। অনেক দিন পর হলেও তিনি আলোচনায় বসেছেন। যে মুহূর্ত থেকে আলোচনায় বসেছেন, সে মুহূর্ত থেকে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে।’ জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘ঐক্য গঠন করতে তার (বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী) যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আমাদের এ লড়াই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই। ভোটের অধিকার আদায়ের লড়াই। তার যোগদানের মধ্য দিয়ে লড়াইয়ের মাত্রা বেড়ে গেল। আমরা এখন একসঙ্গে লড়াই করব।’ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার জন্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে মোবারকবাদ জানাই। তার যোগদানের মধ্য দিয়ে আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতি লাভ করবে।

ঐক্যফ্রন্টে কাদের সিদ্দিকীর যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে ধন্যবাদ জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, তাকে ঐক্যফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রংপুরে আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী মইনুল হোসেনের ওপর হামলা প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার ওপর যে হামলা হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট তার নিন্দা জানায়। ঐক্যফ্রন্ট তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানায়। এ ছাড়া ব্রিফিংয়ে বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। এ সময় বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ, ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন যদি ৮ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে তবে ১০ নভেম্বর ইসি অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ ছাড়া ৮ নভেম্বর সড়ক পথে রাজশাহী যাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এরপরে ১১ নভেম্বর বরিশাল এবং পর্যায়ক্রমে খুলনা, ময়মনসিংহ জনসভা করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

সর্বশেষ খবর