মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাপার সংলাপ

সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার না করাসহ আট দফা প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক

সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার না করাসহ আট দফা প্রস্তাব

সংলাপ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গতকাল গণভবনে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে সংলাপে যোগ দেন ৩৩ সদস্যের সম্মিলিত জাতীয় জোটের নেতারা। —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আগামী সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার না করা ও প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ আট দফা দাবি জানিয়েছেন। সংলাপ শেষে পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বনানীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে গঠনমূলক পরিবেশে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। সংবিধানসম্মত নির্বাচন হবে, এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টি পুরোপুরি ঐকমত্য পোষণ করেছে। আমরা জোটবদ্ধভাবে মহাজোট ১৪ দলসহ একসঙ্গে নির্বাচনে লড়ব। একসঙ্গে সরকার গঠন করব। এ বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য হয়েছে। নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে কথা হয়নি। সেটা আরও ছোট পরিসরে ছোট কমিটি করে আলোচনা হবে।

জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে ৩৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে অংশ নেন। সন্ধ্যা ৭টায় সম্মিলিত জাতীয় জোটের নেতারা গণভবনে প্রবেশ করেন। সংলাপের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংলাপে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলের উদ্দেশে সূচনা বক্তবে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, যেহেতু সামনে নির্বাচন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সব দলের সঙ্গে মতবিনিময় করছি। আমরা চাই একটা অর্থবহ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। কারণ বাংলাদেশ আজকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে তিনি উন্নতির পথে দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রেখে গেছেন। জাতির পিতা বাংলাদেশকে যে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রেখে গেছেন সেখান থেকে আমরা দেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি জাতির পিতার আদর্শের পথ ধরে। আমাদের এ পথযাত্রায় আপনারা জাতীয় পার্টি পাশে ছিলেন, আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আমরা একসঙ্গে এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছি। আজকে যে সহযোগিতা পেয়েছি সে জন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, নির্বাচন মানুষের ভোটের অধিকার, সে অধিকারটা তারা প্রয়োগ করবে। আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধি যারা আমাদের কাজ দেশের মানুষের সেবা করা এবং দেশকে উন্নত করা, আমরা সেভাবেই দেশকে উন্নত করেছি। এই উন্নয়নের ধারাটা যেন অব্যাহত থাকে সেটা আমাদের লক্ষ্য এবং এটা আমাদের ধরে রাখতেই হবে। সংলাপে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের শীর্ষনেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপে অংশ নেন জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমীন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এম এ ছাত্তার, কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, আলহাজ সাহিদুর রহমান, শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, ফখরুল ইমাম, মজিবুল হক চুন্নু, সালমা ইসলাম, সুনীল শুভরায়, এস এম ফয়সল চিশতী, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, মসিউর রহমান রাঙ্গা, এ টি ইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ, আতিকুর রহমান আতিক, মেজর (অব.) খালেদ আক্তার, সফিকুল ইসলাম সেন্টু, শামীম হায়দার পাটোয়ারী। যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা, নুরুল ইসলাম ওমর, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মাওলানা এম এ মান্নান, মহাসচিব এম এ মতিন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাহফুজুল হক, যুগ্ম মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমেদ, জাতীয় ইসলামী মহাজোটের চেয়ারম্যান আবু নাসের ওয়াহেদ ফারুক, বিএনএ’র চেয়ারম্যান সেকেন্দার আলী মনি।

রাজনৈতিক মেরুকরণে জোটের সমীকরণ হবে : সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মেরুকরণের ওপর নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সমীকরণ। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা জোটবদ্ধভাবে মহাজোট ১৪ দলসহ একসঙ্গে নির্বাচনে লড়ব। একসঙ্গে সরকার গঠন করব। এ বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য হয়েছে। তিনি বলেন, রাজনীতিতে যেভাবে মেরুকরণ হবে তেমনি জোটেও ঠিক সেভাবে সমীকরণ হবে।

এবার ইভিএম ব্যবহার না করাই ভালো হবে : রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, গণভবনে ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে’ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের প্রস্তাবগুলো সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবেন। পরে হয়তো আবারও আমরা তার সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করব। চেয়ারম্যান বলেছেন, যে অর্থে অন্য দুটি জোট আপনার সঙ্গে সংলাপে বসেছে, আমি সে অর্থে সংলাপ করতে আসিনি। আমরা এসেছি আপনার সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নিয়ে কিছু খোলামেলা আলোচনা করতে। এসেছি আপনার কথা শুনতে। কোনো দাবি দাওয়া নিয়ে আসিনি। নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন, তা জানতে এসেছি। একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমিও কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করব।

 আপনি তা বিবেচনা করবেন, আমাদের সেই প্রত্যাশা থাকবে। তিনি জানান, নির্বাচনকালীন সরকারে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর অংশগ্রহণ যেন থাকে তার অনুরোধ জানিয়েছেন এরশাদ। ‘নির্বাচনকালীন সরকারের প্রতিনিধিত্বের জন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছি’—বলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার।

রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, নির্বাচন করতে হবে অবশ্যই সংবিধানের আওতায়। অনির্বাচিত তথাকথিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় তিক্ত অভিজ্ঞতা জাতীয় পার্টি ভোগ করেছে। “১৯৯১ ও ৯৬ সালের নির্বাচনে তথাকথিত নিরপেক্ষ সরকার আমাদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড রাখেনি। ২০০১ সালে নিরপেক্ষ সরকার সম্পূর্ণভাবে একটি দলের হয়ে কাজ করেছে। ওয়ান-ইলেভেনের সরকার শীর্ষ রাজনীতিক নেতাদের রাজনীতি থেকে মাইনাস করার চেষ্টা করেছে। সেই অন্ধকার যুগে আর আমরা ফিরে যেতে পারব না।”

নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করার প্রস্তাব দিলেও তাদের হাতে যেন বিচারিক ক্ষমতা না দেওয়া হয় তার প্রস্তাব রেখেছেন এরশাদ।

হাওলাদার বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা এই প্রস্তাব করছি।’

পরে তিনি জানান, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার জন্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে যেন উদ্যোগ নেওয়া হয় তার প্রস্তাব রেখেছেন জাতীয় পার্টির নেতারা।

আসন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ‘জনমনে দ্বিধা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘জনমনে একটি আধুনিক পদ্ধতি হলেও ভোটাররা এখনো ইভিএম ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করার পর ইভিএম ব্যবহার করা হোক। এবার ইভিএম ব্যবহার না করাই ভালো হবে।’

সংলাপে প্রাদেশিক ব্যবস্থার প্রবর্তনের দাবিও জানিয়ে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদে প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের আইন পাসের দাবি ছিল এই সংলাপে।

রুহুল আমিন হাওলাদার জানান, অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়ার পর কোনো দল যদি নির্বাচনে না আসে, তা আর ‘দেখার অবকাশ নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন এরশাদ।

কিছু দিন আগে জামালপুরে এক সমাবেশে এরশাদ জানিয়েছিলেন, সংলাপে তিনি মহাজোটের সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা করবেন।

এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় এসেছে, সেগুলো মিডিয়ায় বলার মতো না।

‘সরকারে আমাদের দলের তিনজন মন্ত্রী রয়েছেন। ধারাবাহিকতার বিষয় রয়েছে। সে বিষয়গুলো আপনাদের মনে রাখতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে অনেক কথা আসে। সেটা সংবাদপত্রে যাওয়ার জন্য নয়।’

মহাজোটের সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে হাওলাদার বলেন, ‘জোটের ব্যাপারে আলোচনা করব পরবর্তীতে। আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হলে জোট হতে পারে। জোটের বিষয়ে আমরা ছোট করে দেখতে চাই না। সময় নির্ধারণ করবে, সময়ের দাবি কী।’

হাওলাদার জানান, আট দফা দাবিসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নানা ইস্যু নিয়ে পরবর্তীতে ‘স্বল্প পরিসরে’ আলোচনার সুযোগ রয়েছে।

রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, আপনারা অপেক্ষা করেন আরও কিছু চমক আসবে সারপ্রাইজ আসতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সংবাদ সম্মেলন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলা, এস এম ফয়সল চিশতী, আতিকুর রহমান আতিক, সফিকুর রহমান সেন্টু, সোলায়মান আলম শেঠ ছাড়াও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এম এ মতিন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর