বুধবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

৭ নভেম্বর একটি হঠকারী উদ্যোগ

কর্নেল জাফর ইমাম (অব.) বীরবিক্রম

৭ নভেম্বর একটি হঠকারী উদ্যোগ

৭ নভেম্বর ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান ছিল না। ৩ নভেম্বর সংঘটিত হওয়ার মূল লক্ষ্য ছিল খুনি মোশতাক গংদের উচ্ছেদ করা। সফলতার সঙ্গে খালেদ গংরা সেদিন মোশতাককে উত্খাত করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরে যাওয়ার ষড়যন্ত্রকে বানচাল করে দিয়েছিল। ওইদিন আমরা দুঃখজনকভাবে জাতীয় চার নেতাকে হারিয়েছিলাম। সেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কোন ট্যাংকবহর বা সেনাবাহিনীর  আক্রমণ হয়নি। হাজারের অধিক জেল পুলিশসহ সংরক্ষিত কারাগারে গিয়েছিল একটি জিপে চারজন ঘাতক সদস্য মোশতাকের নির্দেশে। পরে মোশতাকের স্বীকারোক্তি আমরা ক্যাসেটবন্দি করি। খালেদ গংরা যদি ৩ নভেম্বর এই অভ্যুত্থান না করতেন , মোশতাক যদি আর কয়েক মাস টুপির রাজনীতি চালু রাখতেন তাহলে চার নেতার ঊর্ধ্বে সময়ের ব্যবধানে আরও কয়েক শত সে হত্যা করত এবং বাকিদের তার আনুগত্য স্বীকার না করলে জেল-জুলুম ও নির্যাতন ও গুমের শিকার হতে হতো। ৭ নভেম্বর ওই দিন সংঘটিত হতো না। ইতিহাসের অন্য কোনো দিন জাসদ কি করতে পারত ইতিহাস তা মূল্যায়ন করবে। ৭ নভেম্বর জাসদের এই হঠকারী উদোগের সফলতা শুধু খালেদের সফলতা বানচাল করাই মূল্যায়নে আসে। পাশাপাশি তাদের এই অপরিপক্ব ব্যর্থ প্রয়াস ও হঠকারী জিয়াকে বন্দীদশা থেকে এনে পরবর্তীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পথকেই প্রশস্ত করেছিল সৈনিক সংস্থা সৃষ্টি মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হত্যাসহ পুরো উদ্যোগ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ। বলা হয়ে থাকে, ৭ নভেম্বরের ঘটনা ছিল ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান। কিন্তু এ কথাটি ঠিক নয়। অনেক আগে থেকেই সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলোতে গোপন সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম চালু ছিল। তারা তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশে ৭ নভেম্বরকে অভ্যুত্থান করার সময় হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ৬ নভেম্বর রাতে এলিফ্যান্ট রোডে কর্নেল তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেনের বাসায় জাসদ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গোপন বৈঠক করে এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ঢাকার সর্বত্র তারা একটি লিফলেট বিতরণ করে। সন্ধ্যায় ওই লিফলেট বিতরণের পর ঢাকায় বিভিন্ন মহলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও সৈনিক সংস্থার ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, সেনানিবাসে রাত ১২টা ১ মিনিটে সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে ‘Motivated’ সৈনিকরা ওপরের দিকে গুলি শুরু করবে এবং এটাই হবে জাসদ, গণবাহিনীর জন্য অভ্যুত্থান শুরুর সংকেত। সঙ্গে সঙ্গে তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল বের করবে। আদমজী থেকে একটা বড় মিছিল বের করার পরিকল্পনা ছিল। সৈনিকদের বিদ্রোহের সমর্থনে বাইরে মিছিল চলবে এবং জনসমর্থন পক্ষে আনার  প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে। ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল, একই সময়ে বাইরে পরিকল্পনা অনুযায়ী যে মিছিলটি ঢাকায় হয়েছিল তা আকারে খুব একটা বড় ছিল না। সকালের দিকে যদিও খণ্ড খণ্ড মিছিল রাস্তায় ছিল, সে মিছিলগুলোর মধ্যে জাসদ ছাড়াও অনেক আওয়ামী লীগবিরোধী লোক ছিল। ঢাকা সেনানিবাসে সিপাহিদের বিদ্রোহের ঘটনার সমর্থনে যদি জাসদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীতে ব্যাপক মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমর্থন ব্যাপক জোরদার করতে পারত, তাহলে জিয়াউর রহমান লংমার্চের পরিকল্পনা বাতিলসহ আরও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে সংকটে পড়তেন। জনগণের মধ্যে জাসদের সমর্থন ব্যাপক ছিল না এবং পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার সঠিকভাবে পরিকল্পনা মোতাবেক না করতে পারায় বেলা ১০-১১টার মধ্যে জাসদের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। ঢাকা সেনানিবাসের ভিতরে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে নিয়ে ৭ নভেম্বর সকাল ১০টা-১১টা পর্যন্ত সৈনিক সংস্থার ‘সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’ স্লোগান সহকারে অফিসার হত্যা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। কর্নেল তাহের সেনানিবাসের বাইরে থেকে সৈনিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। যদিও অধিকাংশ সিপাহি এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু বেশিরভাগ সৈনিক আসল পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য জানত না। অনেকেই অফিসার হত্যাকে সমর্থন না করে সেনাবাহিনীতে ফিরে আসুক চেয়েছিল, অফিসার হত্যা অব্যাহত রেখে Chain of Command পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেন না আসে সে জন্য জাসদের একটি অংশ ছাড়াও দেশি-বিদেশি আরও একটি চক্রও জড়িত ছিল বলে অনেকের অভিযোগ রয়েছে। জাসদের একটি অংশও এ ব্যাপারটিকে সমর্থন করছিল না। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে কর্নেল তাহেরদের পরামর্শক্রমে সৈনিক সংস্থার সদস্যরা জিয়া-ভক্ত অন্য সৈনিকদের নিয়ে জিয়াকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে অর্থাৎ কর্নেল রশীদের ইউনিটে নিয়ে আসে। সৈনিক সংস্থা ও জাসদ চেয়েছিল, সে মুহূর্তে যেহেতু জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাকে সামনে রেখে সিপাহিদের একতাকে তাদের পক্ষে আরও সুদৃঢ় করা এবং তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। জিয়া বিষয়টা বুঝে ওঠার জন্য, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর কমান্ড ঠিক করে আনার জন্য প্রথম কয়েক ঘণ্টার জন্য সব ব্যাপারে জাসদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন। ঢাকা সেনানিবাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের পাশাপাশি জিয়া জাসদের রব, জলিলসহ অন্যদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন এবং ১২টার মধ্যে জিয়া Chain of Command মোটামুটিভাবে ঠিক করে ঢাকা সেনানিবাসের শৃঙ্খলা অনেকটা ফিরিয়ে আনেন। এক কথায় সেনানিবাসের পরিস্থিতি জিয়া নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ঢাকায় তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাসদের লংমার্চের প্রস্তুতি চলছিল। সেনাবাহিনীর সৈন্যবোঝাই কয়েকটি ট্রাকবহর মিছিল করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যায়। জিয়ার ১২টায় লংমার্চে যোগদানের জন্য শহীদ মিনারে আসার কথা ছিল। তিনি আর এলেন না। সেনাবাহিনীর যে অংশটি সে সময় শহীদ মিনারে গিয়েছিল তারা লংমার্চের উদ্দেশ্যে সমবেত জাসদ কর্মী ও নেতৃবৃন্দকে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে মারধর করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। জাসদ এর আগমুহূর্ত পর্যন্ত জিয়া এবং তাহেরের নামে স্লোগান দিচ্ছিল। শহীদ মিনারের আশপাশে মোশতাকের কিছু পোস্টার ও ছবি ছিল। জাসদের উত্তেজিত নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেয় ও মোশতাকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। এর আগে কর্নের তাহের রেডিও স্টেশনে এসেছিলেন ভাষণ দেওয়ার জন্য। সেখানে তখন মোশতাকও উপস্থিত ছিল। তাহের বা মোশতাক কাউকেই ভাষণ দিতে দেওয়া হলো না। জিয়াকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করার আগে কর্নেল তাহের যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে ৭ নভেম্বর ভোরে রেডিওতে ভাষণ দিতে পারতেন এ জন্য যে, তখন পরিস্থিতি অনেকাংশে তাহেরের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সর্বত্র একটা বিভ্রান্তি ও থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। সে ক্ষেত্রে সেনানিবাসের বাইরে জাসদের রাজনৈতিক Mobilization ব্যাপক হতো এবং ভাষণের পর পর জিয়াকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করলে কর্নেল তাহের কিছু সময়ের জন্য সেনাবাহিনীতে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে পারতেন। গৃহবন্দী থেকে জিয়াকে মুক্ত করে আনার সময় তাকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, দেশব্যাপী বিশেষ করে ঢাকায় তাদের সমর্থনে ছাত্র, শ্রমিক, জনতার ঢল নামবে এবং পুরো সেনাবাহিনীর সৈনিকরাও একতাবদ্ধ রয়েছে। জিয়া দ্বিতীয় ফিল্ডে বসে দেখলেন, সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মধ্যে যে অংশটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের সমর্থনে বাইরে কোনো ব্যাপক রাজনৈতিক সমর্থন নেই অর্থাৎ জাসদ তাদের পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়েছে। ওই পরিস্থিতিতে কারও পক্ষে সেনাবাহিনীকে একতাবদ্ধ করা হয়তো সম্ভব ছিল না বিধায় জিয়া সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জোর দেন এবং তার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন। এ ক্ষেত্রে জিয়া অনেক সৃষ্ট সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন। জিয়া যদি লংমার্চে আসতেন এবং নেতৃত্ব দিতেন, দেশের অবস্থা কী হতো তা উল্লেখ না করে বলব, জাসদ পরবর্তীতে জিয়াকে কখনো তাদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করে নিত না। শেষ পর্যন্ত তাহেরই নেতৃত্বে আসার চেষ্টা করতেন। জিয়ার এ ব্যাপারে সজাগ উপলব্ধি ছিল। তাই জিয়া বেলা ১১টা পর্যন্ত জাসদের সঙ্গে ঐকমত্যে ছিলেন। ১১টার পরে লংমার্চে শরিক না হয়ে জাসদের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনানুষ্ঠানিকভাবে ছিন্ন করে জিয়া সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, সে মোতাবেক তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সে পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন। জিয়া বেলা ১১টার পরে জাসদের সঙ্গে তার পূর্বপ্রতিশ্রুতি মোতাবেক আর কোনো সমঝোতা রক্ষা করছিলেন না এবং আরও পরবর্তীতে জাসদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একের পর এক অ্যাকশনে গিয়েছিলেন। সে জন্য জাসদ জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে। জিয়াও ১১টার পরে লংমার্চে না গিয়ে প্রশাসন ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বিশেষ করে আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে লংমার্চের নির্ধারিত সময় দুপুর ১২টার আগেই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরে নিয়েছিলেন। জিয়া লংমার্চে না গিয়ে কৌশলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে এনে বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও Chief Marshal Law Administrator রেখে জিয়া নিজে সেনাপ্রধান ও Deputy Chief Marshal Law Administrator হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়ার কৌশলগত এ ভূমিকার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে তখন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল না। সবাই আশা পোষণ করছিল, জিয়া নতুন নির্বাচন দিয়ে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করবেন। ৭ নভেম্বরের প্রথম পর্বে সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে জিয়াকে গৃহবন্দী থেকে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসা, জিয়ার সঙ্গে জাসদের সমঝোতা পরে সমঝোতা ভেঙে যাওয়া এবং সর্বোপরি দ্বিতীয় পর্বে জাসদ ও মোশতাক গংদের বাদ দিয়ে ব্যক্তি-সমর্থনে ও কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার কারণে ৭ নভেম্বর বিপ্লব দিবস হিসেবে সঠিক মূল্যায়ন অনেকের কাছে এখনো বিতর্কিত। আমি ৬ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও অন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে Flying Club-এর একটি Cessna Aircraft করে রংপুরে আমার ইউনিটে ফিরে যাই। যাওয়ার সময় খালেদ আমাকে বলেছিলেন, রংপুর ব্রিগেড যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। রংপুরে অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর ইউনিটগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, প্রয়োজনে ইউনিট নিয়ে ঢাকার দিকে আসতে হতে পারে। সর্বশেষ বললেন, ‘যশোর ব্রিগেডের দিকে নজর রাখবে এবং ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।’ আমার যুদ্ধকালীন ইউনিট ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইতিমধ্যেই রংপুর থেকে ঢাকায় এসে শেরেবাংলানগরে অবস্থান করছিল। এ ইউনিট যেহেতু যুদ্ধ চলাকালে আমার অধিনায়কত্বে ‘কে’ ফোর্সের অধীন ছিল সে কারণে এ ইউনিটের ওপর খালেদের আস্থা ছিল অনেক বেশি। ৬ নভেম্বর রাতে ওই ভয়াবহ পরিস্থিতির সময় খালেদ, রক্ষীবাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামান, কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদা দশম বেঙ্গলে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশে কাঁঠালবাগানে খালেদের এক আত্মীয়র বাসা হয়ে শেরেবাংলানগরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। আসাদ গেট পৌঁছার পর ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান সাভার অভিমুখে চলে যান, বাকি তিনজন দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এসে উপস্থিত হন। সারা রাত খালেদ-হুদাদের সঙ্গে জিয়াভক্ত অফিসারদের কথাকাটাকাটি চলছিল। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান আর্টিলারি সেলে কপালে আঘাতপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ শান্তভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। তিনি এক বাসায় শেষ রাত পর্যন্ত প্রায় ২-৩ প্যাকেট সিগারেট শেষ করলেন। রংপুর থেকে ঢাকা আসা এ দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিকদের কোনো বিদ্রোহ ছিল না। মাত্র কিছু সংখ্যক অফিসার ও সৈনিকের মধ্যে ওপরের ইঙ্গিতে কিছুটা উত্তেজনা ছিল। এ দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অদৃশ্য মহলের ইশারায় খালেদ-হুদা-হায়দার তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে কারও যোগসাজশ ছাড়া এ সুপরিকল্পিত নির্মম হত্যাকাণ্ড ভোররাতে সংঘটিত হতে পারে না। বিদ্রোহীদের হাতে যদি খালেদ-হুদা-হায়দার নিহত হতেন তাহলে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় তাদের লাশ ঢাকা সিএমএইচে এনে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করা, তাদের আত্মীয়স্বজনকে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় খবর পৌঁছানো, এমনকি কর্নেল হুদার স্ত্রীকে রংপুর থেকে আনার জন্য হেলিকপ্টার পাঠানো ইত্যাদি ওইদিন ওই উত্তেজিত পরিস্থিতিতে সম্ভব হতো না। সেদিন খুব সুপরিকল্পিতভাবে এও প্রচার করা হয়েছিল যে, খালেদ ইন্ডিয়ান এজেন্ট ছিলেন এবং তার কাছে ইন্ডিয়ান টাকা পাওয়া গেছে যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ প্রচার শুধু খালেদের বিরুদ্ধে ছিল না, পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও ছিল। অন্য রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি এই বীর সেক্টর কমান্ডার মে. জেনারেল খালেদ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত এবং এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য জাতির জানার অধিকার রয়েছে। —অনুলিখন শফিকুল ইসলাম সোহাগ

সর্বশেষ খবর