বৃহস্পতিবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আর আগুন সন্ত্রাস নয়, চাই গণজাগরণের ভোট উৎসব

পীর হাবিবুর রহমান

আর আগুন সন্ত্রাস নয়। আর অগ্নিদগ্ধ মানুষের পোড়াগন্ধ নয়। বার্ন ইউনিটে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার মানুষের আর্তনাদ নয়। রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার পথে ওয়ান-ইলেভেনের মতো অসাংবিধানিক শাসন দিয়ে রাজনৈতিক শক্তি থেকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর ইজ্জত হরণের অমানবিক নির্যাতন নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপির শক্তি নির্ভর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুই দফা সংলাপের পর রাজনৈতিক সমঝোতা হয়নি। সংবিধান থেকে সরকার একচুল না নড়তে যাওয়ায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি আদায় হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ গণভবনে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্য রাখবেন। আমরা আশা করব গণমাধ্যম কর্মীরা দলবাজির ঊর্ধ্বে উঠে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীকে সুনির্দিষ্ট একের পর এক প্রশ্ন করবেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে কোনো প্রশ্নের জবাব খোলা মনে দিতে অভ্যস্ত। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ের চাপ সৃষ্টির জন্য রাজশাহীতে রোডমার্চ করতে যাওয়ার কথা ছিল আজ। সেটি বাতিল করে ৯ নভেম্বর রাজশাহীর গণকপাড়া মোড়ে সমাবেশ কর্মসূচি দিয়েছেন। তাদের দাবির পক্ষে গণজাগরণ ঘটানোর এই উদ্যোগ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। তবে নেতৃত্বকে কঠিন দায়িত্বশীলতার মধ্যে সেই পথে সমর্থকদের নিতে হবে, যাতে এই যাত্রা বা আন্দোলন যেন হঠকারী পথ না নেয়। তেমনি সরকারকেও সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে যাতে অতি উৎসাহী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ বা অতি আগ্রহী দলীয় নেতা-কর্মীরা কোনো বাড়াবাড়ি না করেন। সংঘাতের দরজা যেন কোনো পক্ষ খুলে না দেন। গর্ত খুঁড়লে সেখানে নিজেদের পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কেউই যেন সুযোগ সন্ধানীদের পাতা ফাঁদে পা না দেন। বিএনপির আটক নেতা-কর্মীদের ও গায়েবি মামলার তালিকা প্রধানমন্ত্রী বিবেচনার সঙ্গে যেমন হাতে নিয়েছেন তেমনি আশ্বাস দিয়েছেন রাজনৈতিক কারণে আর কোনো নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না। এই কথা সত্য দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার লড়াইয়ে অবতীর্ণ দুই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে যে তিক্ততার নজীরবিহীন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যে প্রতিহিংসার চিত্র দেখা দিয়েছিল, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দুই দফা সংলাপ সেটি অনেক শীতল করেছে। আলোচনার টেবিল উভয়পক্ষের জন্য উষ্ণ সম্পর্কের দুয়ার খুলেছে। দাবি বড় আকারে আদায় না হলেও মোটা দাগের একটি উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উত্থাপিত দাবির মধ্যে করাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি নাকচ হয়ে গেছে, আইন আদালতের এখতিয়ারের দোহাই দিয়ে। সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও প্রধান উপদেষ্টাসহ ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব সংবিধানবহির্ভূত বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন, নির্বাচনে আসুন। দেখুন আমরা সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারি কিনা। আপনারা বিজয়ী হলে আপনারা সরকার গঠন করবেন। আমরা বিজয়ী হলে আমরা সরকার গঠন করব। খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদই নন, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞই নন আপাদমস্তক সততার সঙ্গে আজীবন রাজনৈতিক সংকটে সংলাপের কথা বলেছেন, সংবিধান ও আইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছেন। আমাদের বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কারণে আটক ও মামলার শিকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের সব ধরনের হয়রানি থেকে যেমন মুক্ত করে দেবেন তেমনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দায়িত্বশীল অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা পাশে থাকার সুবাদে চলমান আন্দোলনকে কোনো হঠকারী সহিংস পথে নিয়ে যেতে দেবেন না।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও তার এক বছর পরে যে সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি দেশ দেখেছে তা কারও জন্য সুখকর ছিল না। মানুষ মরেছে, মানুষ পুড়েছে, দেশের অর্থনীতির সর্বনাশ হয়েছে। সরকার যেমন স্বস্তিতে থাকেনি তেমনি বিরোধী দল সুবিধা লাভ দূরে থাক নির্যাতন ও মামলার শিকার হয়েছে, সাংগঠনিক ভাবে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। সেই সহিংসতার বীভৎস চিত্র পুনরায় মানুষ আর দেখতে চায় না। দেশের মানুষের আবেগ অনুভূতি জুড়ে এখন কেবলি একটি গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক ব্যালট বিপ্লবের আকুতি। রাজনৈতিক শক্তিকে এই আবেগ অনুভূতি চিন্তা ও চেতনায় লালন করে শান্তিবাদী মানুষের মনের চাওয়াকে মূল্য দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ভোট যুদ্ধের উৎসবে দেশকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সমাবেশ ও নির্বাচন কমিশন অভিমুখী যাত্রা নিয়ে গণতান্ত্রিক পথে নিজেদের সম্পর্কে গণজাগরণ ঘটাতে পারে ঐক্যফ্রন্ট।

সরকার পক্ষও নির্বাচনী জনসংযোগে জনজোয়ার তৈরি করতে পারে। গণসমর্থন আদায়ের এই প্রতিযোগিতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির রূপ ও সৌন্দর্যকে যেমন বর্ধিত করে, তেমনি মানুষের মধ্যে সৃষ্ট সব উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করে ভোট উৎসবের আনন্দ দিতে পারে। সম্প্রতি সাভারে আরিচা মহাসড়কে রাস্তা পারাপারের সময় একজন শ্রমিক আহত হওয়ার জের ধরে একটি দূরপাল্লার বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। আগুন আতঙ্কে বাসের পাঁচজন যাত্রী আহত হয়েছেন। বাসে আগুন সন্ত্রাস অতীতের সহিংস সন্ত্রাসের রাজনীতি থেকে এসেছে। এর পুনরাবৃত্তি আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচি এবার দেখতে চাই না। গোটা দেশের জনগণ সব দলের অংশগ্রহণে একটি ব্যালট উৎসবের অপেক্ষায় প্রস্তুত।

রাজনীতিতে নানা সময়ে নানা কৌশল নিতে হয়। যে কৌশলের অংশ হিসেবে সেনা শাসন জমানায় রাজনৈতিক কারণে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৮১ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজয় জেনেও ড. কামাল হোসেন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়েছিলেন। এমনকি গণরায় ছিনতাই হওয়ার আশঙ্কা জেনেও সেনা শাসন জমানায় ৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। পরাজিত হয়েও ৯১ সালের সংসদ নির্বাচনকে নিরপেক্ষ হয়েছে বলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। রাজশাহী যাচ্ছেন, প্রয়োজনে অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও সমাবেশ করে যান। গণজাগরণ ঘটিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড রাখার নিশ্চয়তাই দেননি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দাবি সানন্দে গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচনকালীন তার সরকারের সবার গাড়িতে দলীয় পতাকার বাইরে জাতীয় পতাকা থাকবে না। কোনো নির্বাহী ক্ষমতা কেউ ভোগ করবেন না। তিনি নিশ্চয়তার ওয়াদা রাখবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধ গ্রহণ করে, বিশ্বাস ও আস্থা রেখে নির্বাচনে অংশ নিন। আপনারা কেমন রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চান তা মানুষের সামনে তুলে ধরুন। শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে এটা যেমন সত্য তেমনি মানুষের মধ্যে অনেক আশা পূরণ না হওয়ার বেদনাও রয়েছে। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কার্যকর শক্তিশালী সংসদকে সব আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু করে জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ শাসন ব্যবস্থা যেমন মানুষের প্রত্যাশা তেমনি নিজেদের জীবন মান উন্নত করতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে অনড়। তাই একদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ও অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী অঙ্গীকার জনসংযোগ প্রচার প্রচারণা মিলিয়ে গণজাগরণের মহাপ্লাবনের ভিতর দিয়ে এবারের জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ব্যালট বিপ্লবের উৎসব হোক। ভোট উৎসবের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী সরকারের পাশাপাশি শক্তিশালী বিরোধী দল, কার্যকর প্রাণবন্ত সংসদ, সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিক সেটিই মানুষের প্রত্যাশা। শান্তি ও সমঝোতার পথই শেষ কথা। অতীতের সংঘাত ও সহিংতার অন্ধকার পথ আর যেন ফিরে না আসে আমাদের রাজনীতিতে। আজ সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের যে তফসিল ঘোষণা করবেন তা মেনে নিয়ে উভয় পক্ষ ভোট উৎসবে শামিল হোন। আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া অঙ্গীকার যাতে কার্যকর হয় সেদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নজর দিন। নির্বাচন বর্জনের রাজনীতি সাফাল্য না আনলে গণতন্ত্র রাজনীতি এক কথায় মানুষের জন্য যে ক্ষতি বয়ে আনে তা আমাদের পিছিয়ে দেয়। আমরা আর পিছিয়ে যেতে চাই না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর