শুক্রবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাসপাতাল থেকে আবার কারাগারে খালেদা জিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাসপাতাল থেকে আবার কারাগারে খালেদা জিয়া

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আবারও নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়েছে। গতকাল এই কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মাহমুদুল কবির খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে থাকা নাইকো দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি গ্রহণ করেন। আংশিক শুনানি শেষে ১৪ নভেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করে মামলার কার্যক্রম মুলতবি করেন। গতকাল বেলা পৌনে ১২টার দিকে খালেদাকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর হুইল চেয়ারে করে এজলাসে হাজির করা হয়। শুনানির প্রথম দিন এ মামলার অন্যতম আসামি মওদুদ আহমদ নিজেই তার অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু করেন। এতদিন বকশীবাজারে কারা অধিদফতরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে বসে ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মাহমুদুল কবির নাইকো দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়াকে হাজির করতে না পারায় এবং অপর আসামি মওদুদ আহমদের বারবার সময়ের আবেদনে গত ডিসেম্বর থেকে এ মামলা অভিযোগ গঠনের শুনানি পর্যায়ে আটকে ছিল। এর মধ্যেই বুধবার এ মামলার কার্যক্রম স্থানান্তরের নির্দেশ দেয় আইন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপন জারির পর নাইকো মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। খালেদার হাজিরাকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল এবং নাজিমুদ্দিন রোডে কারাগার এলাকায় নেওয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা। বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে পুলিশের একটি কালো গাড়ি বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে খালেদাকে নিয়ে কারাগারের পথে রওনা হয়। ১৫ মিনিটের মাথায় গাড়িটি কারাভবনের মূল ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকে। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র গতকাল সকালেই হাসপাতাল থেকে কারাগারে নেওয়া হয়। বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল হারুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘দীর্ঘ এক মাস চিকিৎসা শেষে উনি (খালেদা জিয়া) আজকে সাড়ে ১১টায় তার নিজ আবাসস্থলে ফিরে গেছেন। তার শারীরিক অবস্থা যথেষ্ট স্থিতিশীল এবং আমরা চেষ্টা করেছি উনাকে কার্যকর চিকিৎসা সহায়তা দিতে। তিনি বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে এবং সহায়তা চাইলে আমাদের চিকিৎসক দল কারাগারে গিয়ে তাকে চিকিৎসা দিয়ে আসবে।

ওনাকেও আদালতে আনুন : বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে এজলাসে ওঠেন বিচারক। এ সময় মামলার আসামি সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অভিযোগ গঠন শুনানি পেছাতে আবেদন করেন। আদালত তার আবেদনটি নামঞ্জুর করে শুনানি করতে বলেন। মওদুদ আহমদ বলেন, এখানে মামলা পরিচালনার কোনো পরিবেশ নেই। আমি সুপ্রিম কোর্টে মামলা ছেড়ে এসেছি। তখন বিচারক বলেন, আজ সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া যাবে না। এই মামলাটি শেষ করতে হবে। এরপর মওদুদ নিজের পক্ষে শুনানি শুরু করেন। শুনানিতে তিনি মামলার এজাহার পড়তে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি এ ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়েছে তা বলেন। বিচারক তখন বলেন, এটা আপনার অংশ নয়। এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, নাইকো দুর্নীতির ঘটনায় ওনার নামে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) তো একটা মামলা হয়েছে। কাউকে সেভ করবেন আর কাউকে বলি দেবেন এটা ঠিক নয়। ন্যায়বিচারের জন্য ওনাকে আদালতে হাজির করা হোক। তখন বিচারক খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে বলেন, ওই মামলাটি তো শেষ হয়ে গেছে।

খালেদাকে কারাগারে নেওয়া আদালত অবমাননা : হাই কোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার পর আদালতকে অবহিত না করেই তাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আদালত অবমাননা হয়েছে বলে দাবি করেছে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। গতকাল খালেদা জিয়াকে আদালতে নেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি করেন সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, গত ৬ নভেম্বর খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে আমরা আবেদন করেছিলাম কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সে আবেদন তারা গ্রহণ করেনি। খবর পেলাম, মাত্র আধা ঘণ্টার নোটিসে তাকে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজসহ আদালতকে কিছুই না জানিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিষয়টি জানানো উচিত ছিল। আদালতের নির্দেশে তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আদালতকেও অবহিত করেনি। এতে বিচার বিভাগের আদেশ অবজ্ঞা করা হয়েছে।

মামলার বৃত্তান্ত : বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় এ মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে ‘তুলে দেওয়ার’ মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীসহ আরও সাতজন।

এটা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা : ফখরুল : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মেডিকেল বোর্ডের আপত্তি সত্ত্বেও খালেদা জিয়াকে আদালত ও কারাগারে নেওয়া হয়েছে। এটা সরকারের চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন। আমরা এর তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে তাঁকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। গতকাল পুরনো কারাগারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে নাইকো দুর্নীতি মামলার শুনানি শেষে কারা ফটকে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ অভিযোগ করেন।

তিনি বলেন, সম্পূর্ণ অন্যায় ও বেআইনিভাবে খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউ হাসপাতাল থেকে বের করে আদালতে আনা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। এই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে সরকার রাজনৈতিক চরম প্রতিহিংসায় তাকে আদালতে নিয়ে এসেছে। তাকে আবার এই কারাগারেই রেখে দেওয়া হয়েছে।

চাপ দিয়ে ছাড়পত্র নিয়েছে : ড্যাব : চিকিৎসককে চাপ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছাড়পত্র নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র চিকিৎসকরা। রোগী নিয়ে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে প্রফেসর সৈয়দ আতিকুল হকের কাছ থেকে ছাড়পত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন তারা। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত ছাড়াই তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গতকাল সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে তারা এ অভিযোগ করেন। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্রফেসর ডা. মো. সাইফুল ইসলাম। এ সময় বিএসএমএমইউর সাবেক প্রোভিসি প্রফেসর ডা. আবদুল মান্নান মিয়া, প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, প্রফেসর ডা. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, প্রফেসর ডা. আবদুস কুদ্দুস, ডা. এ কে এম আমিনুল হক, প্রফেসর ডা. মোস্তাক রহিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর