শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
রাজশাহীতে ঐক্যফ্রন্টের জনসভা

খালেদা জিয়ার মুক্তি ও ভোটের পরিবেশ সৃষ্টির দাবি

শফিউল আলম দোলন ও কাজী শাহেদ, রাজশাহী থেকে

খালেদা জিয়ার মুক্তি ও ভোটের পরিবেশ সৃষ্টির দাবি

রাজশাহীর জনসভায় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজশাহীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিশাল জনসভায় নেতারা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করার দাবি জানিয়ে বলেছেন, দেশে এখন কোনো নির্বাচন বা ভোটের পরিবেশ নেই। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। এসব ছাড়াই একতরফাভাবে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে, যা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। গতকাল বিকালে রাজশাহী মহানগরীর মাদ্রাসা মাঠে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য জাতীয়  নির্বাচন এবং বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দী ও নেতা-কর্মীর মুক্তি দাবি এবং ৭ দফা দাবিতে এ জনসভার আয়োজন করা হয়। ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন, সাত দফা দাবি না মানলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, এখন সংকট আরও কঠিন, আরও ভয়াবহ। আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবি আদায় করতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনের এই তফসিল গ্রহণযোগ্য হবে না। ঐক্যফ্রন্টের মহাসচিব বলেন, আজকে প্রশ্ন, গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না? আমাদের কথা বলার অধিকার, ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে কি না, তা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন জনসভায় যোগ দেননি। তবে তিনি মোবাইল ফোনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের এ জনসভায় প্রথম যোগ দেন এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে রাজপথে আন্দোলনের বিকল্প নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাজশাহীর সমন্বয়ক ও সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর সভাপতিত্বে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, নাগরিক ঐক্যের এস এম আকরাম, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, যুগ্ম-মহাসচিব হারুন অর রশীদ হারুন, রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিএনপি নেতা রাজশাহীর সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, শাহিন শওকত, নাদিম মোস্তফা, দেবাশীষ রায় মধু, আবু বকর সিদ্দিক, সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

বিএনপি মহাসচিব দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আপনারা উপস্থিত হয়েছেন। পথে পথে বাধা অতিক্রম করে আপনারা গণতন্ত্রের জন্য এসেছেন। এখন সংকট আরও কঠিন, আরও ভয়াবহ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে এই স্বৈরাচার সরকার আটকে  রেখেছে। তিনি অসুস্থ, হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছিল, সেখান থেকে তাঁকে জেলখানায় নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। তারা পুলিশ দিয়ে, বন্দুক-পিস্তল দিয়ে মানুষকে গণতন্ত্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের মধ্যে ঐক্য গড়ে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য লড়াই করছি। সে জন্য আমরা সংলাপে বসেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে হবে, দেশনেত্রীকে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু তারা তা করেনি। তিনি বলেন, দেশে এখন নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। সব রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ-সুবিধা নেই। নির্বাচনী মাঠ বিরোধীদের জন্য সমতল নয়। সে কারণে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে দিতে হবে। ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়া ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিলেন বলে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি, এবারও তাঁকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, সাত দফার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। প্রশাসনকে বলতে চাই, আপনারা আজকে সমাবেশে জনগণকে আসতে বাধা দিয়েছেন। কিন্তু জনগণের জোয়ার বাধা দিয়ে রাখা যায় না। কারণ এ সরকার জনগণকে ভয় পায়। তারা ৫ জানুয়ারি প্রহসন করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছে। তিনি বলেন, যে দেশের প্রধান বিচারপতি ন্যায়বিচার পায় না, সে দেশের জনগণ কীভাবে ন্যায়বিচার পাবে। আ স ম আবদুর রব বলেন, আমরা নির্বাচনে যেতে চাই, আমাদের উসকানি দেবেন না। ৭ দফা না মানলে দেশে নির্বাচন হবে না, এটাই সত্য। আওয়ামী লীগের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৭০ দিন হরতাল করেছিলেন, শাহবাগে বাসে পেট্রল দিয়ে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা করেছিলেন, সেগুলো কি ভুলে গেছেন? তখন আপনাদের আন্দোলন বেআইনি ছিল না, এখন সরকারে আছেন এখন আমাদের আন্দোলন বেআইনি। এসব বাদ দেন। এবার আর রক্ষা নাই। আমরা জনগণের সঙ্গে আছি। জনগণও আমাদের সঙ্গে আছে। কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, নির্বাচন হবে কি না, কিংবা আমরা সে নির্বাচনে অংশ নেব কিনা সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, এ সরকারের হাত থেকে গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার উদ্ধার করতে হলে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।  বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি বিএনপির সভায় আসিনি, কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের সভায় এসেছি। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চাইলে ঐক্যফ্রন্ট অটুট রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই বেগম খালেদা জিয়া। তাকে বন্দী রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, এর আগে শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম আলোচনায় বসুন, বসেননি। এবার আলোচনায় বসেছেন। যেদিন আলোচনায় বসেছেন সেদিনই আপনাদের বিজয় হয়েছে। আপনারা কি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় চান? বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই বেগম খালেদা জিয়া, তাকে বন্দী রাখা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, বিএনপি রাজাকারের গাড়িতে পতাকা দেয়নি। আওয়ামী লীগ রাজাকারের গাড়িতে সর্বপ্রথম পতাকা দিয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সরকার ক্ষমতা ছাড়তে চায় না, তাই সংলাপ সফল হয়নি। কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটাতে হবে।  তাছাড়া এবার আর ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে পারবে না। বিনা চ্যালেঞ্জে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে না। আর বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে এ দেশে কোনো সংসদ নির্বাচন করতে জনগণ দেবে না।  

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, এক মাঘে শীত যায় না। এটি ভুলে গেলে চলবে না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে যদি এক শীত কারাগারে কাটাতে হয়, শেখ হাসিনাকে ১০ শীত কাটাতে হবে। তিনি আরও বলেন, নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে, একতরফা নির্বাচনী বৈতরণী পার করা সম্ভব নয়। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বানচাল করতে চায় না। ৭ দফা দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। প্রতিহিংসা বন্ধ করে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে সরকারকে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক বলেন, ঐক্যফ্রন্ট যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সরকার সে ফাঁদ পেতেছে। আমরা আবারও নির্বাচন কমিশনের কাছে আহ্বান জানাই তফসিল পেছানোর। আমাদের দাবি না মানলে কোনো নির্বাচন নয়। দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশে মান্না বলেন, ঢাকায় আসেন, দেখি ওরা আমাদের কথা শোনে কিনা। আমরা আলোচনা করে সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করেনি। কিন্তু এরই মাঝে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকারের ভিত নড়ে গেছে। এ সরকারের ভিত হলো পুলিশ, ঘুষ, অনাচার ও দুর্নীতি, গায়েবি মামলা, গ্রেফতার। তারা পালাবার পথ খুঁজছে। আপনারা মাঠে থাকেন। আপনাদের বিজয় সুনিশ্চিত। এবার আপনারা জয়ী হবেন, জয়ী হলে কি হবে? কৃষক শ্রমিকদের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে।

পথে পথে ব্যারিকেড উপেক্ষা করে জনসভায় মানুষের ঢল : রাজশাহীতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় রাস্তায় সব বাধা উপেক্ষা করে বিএনপিসহ জোটের নেতা-কর্মীদের ঢল নামে। বিভিন্ন জেলা থেকে রাজশাহী অভিমুখে বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হলেও সকাল থেকেই বিকল্প পথ হিসেবে নৌকা, ট্রেন বা ছোট ছোট যানবাহন ব্যবহার করে শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। জনসভাস্থল রাজশাহী মহানগরীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসায় জেডিসি পরীক্ষা চলায় দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়।

নির্বাচন কমিশন অভিমুখে পদযাত্রা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আজ কর্মসূচি চূড়ান্ত করবে : তফসিল বাতিল ও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পদযাত্রা কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আজ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বৈঠকে বসে এ কর্মসূচি চূড়ান্ত করবে বলে জানিয়েছেন ফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা রাজশাহী থেকে ফিরছি। শনিবার ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় এ কর্মসূচি চূড়ান্ত হবে।’ এর আগে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি দিনক্ষণ না বললেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতা বলেন, ১০ নভেম্বর এ কর্মসূচি হবে।

সর্বশেষ খবর