বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোটের হাওয়ায় রণক্ষেত্র নয়াপল্টন

পুলিশের গাড়িতে আগুন, গুলি, টিয়ার গ্যাস শেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোটের হাওয়ায় রণক্ষেত্র নয়াপল্টন

নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে গতকাল পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় —রোহেত রাজীব

মনোনয়ন ফরম বিতরণ কার্যক্রমের মধ্যেই রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল দুপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস মিছিল নিয়ে দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনতে এলে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে গেলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নেতা-কর্মীদের ধাক্কাধাক্কি আর পুলিশের ফাঁকা গুলি পরে রূপ নেয় ভয়াবহ সংঘর্ষে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল বিনিময়ের পর পুলিশের টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটে মুহূর্তেই নয়াপল্টন হয় রণক্ষেত্র। সংঘর্ষে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া রাস্তায় চলাচল করা বেশ কিছু যানবাহন তারা ভাঙচুর করে।

তবে বিএনপির নেতা, কর্মী ও সমর্থক এত বেশি ছিল যে, পুলিশ সেখান থেকে একপর্যায়ে পিছু হটে। বেলা ১টা থেকে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এই সংঘর্ষে পুলিশসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পুরো এলাকার দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বন্ধ। এ সংঘর্ষের জন্য দুই পক্ষই পরস্পরকে দোষারোপ করেছে। বিএনপি বলেছে, ‘সরকারের নির্দেশে’ পুলিশ বিনা উসকানিতে তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর ‘হামলা’ চালিয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ বলেছে, নির্বাচন সামনে রেখে ‘ইস্যু তৈরির লক্ষ্যে’ বিনা উসকানিতে বিএনপির কর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় তাদের একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার, দুজন সহকারী পুলিশ কমিশনারসহ ২১ জন পুলিশ এবং দুজন আনসার সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির একপর্যায়ে কার্যালয়ের ভিতরে থাকা দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিচে নেমে এসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বরাত দিয়ে নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে ফুটপাথে অবস্থান গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। পুলিশ বিনা উসকানিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর গুলি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে নেতা-কর্মীরা কার্যালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছিলেন। দুপুরে পুলিশ বিনা উসকানিতে হামলা চালায়। আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। আমি পুলিশকে অনুরোধ করব, শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় এবং গণতন্ত্র ধ্বংস হয়, এমন কাজ করবেন না। কারও নির্দেশে কাজ করবেন না। আপনারা দেশের সন্তান। কারও স্বার্থ রক্ষায় অন্যায় নির্দেশ পালন করবেন না।’

রিজভী বলেন, ‘আমরা গত দুই দিন শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়েছিলাম। আজকে বিনা উসকানিতে হামলা করা হয়েছে। হামলাকালে আমাদের আব্বাস, নাহিদ, মুকুল, মোস্তফা, স্বপন, হারুনসহ ২০ জনের মতো নেতা-কর্মী পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন।’

সংঘর্ষের পর কার্যালয়ের সামনে বিএনপির একটি চিকিৎসক দলকে আহতদের চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের হাসপাতালেও পাঠানো হয়। গুলিতে আহত মহানগর উত্তর ছাত্রদলের নেতা তানভীর আহমেদ খান ইকরাম জানান, পুলিশের ছর্রা গুলিতে বহু নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। কারও চোখে, কারও পেটে, কারও মাথায় গুলি লেগেছে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পুলিশ সদস্যদের দেখতে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। রাত ৯টায় যোগাযোগ করা হলে মামলার প্রস্তুতি চলছিল বলে পল্টন থানা পুলিশ জানিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, তৃতীয় দিনের মতো গতকাল মিছিল সহকারে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসতে থাকেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সকাল থেকেই নেতা-কর্মীদের রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়াতে দিচ্ছিল না পুলিশ। এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার দলটির নেতা-কর্মীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বেলা পৌনে ১টার দিকে বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস কয়েক হাজার লোকের মিছিল নিয়ে আসতে থাকেন। তখন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের উভয় পাশের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যরা বিএনপি নেতা-কর্মীদের ফুটপাথের দিকে অবস্থান নিয়ে রাস্তা ছেড়ে দিতে বলেন। পুলিশ তাদের ফুটপাথের দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। নেতা-কর্মীরা এ সময় পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। নেতা-কর্মীরা মুহূর্তে জঙ্গি রূপ ধারণ করে। পুলিশ এ সময় দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে ব্যর্থ হয়ে বেলা সোয়া ১টার দিকে দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর চড়াও হয় পুলিশ। বিএনপি নেতা-কর্মীরা পুলিশকে উদ্দেশ করে ইটপাটকেল, জুতা এবং অন্যান্য বস্তু নিক্ষেপ করতে থাকে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। মুহূর্তেই আশপাশের সব দোকানপাট, অফিস-আদালতের দরজা-জানালা বন্ধ হয়ে যায়। অনেকে দোকান খোলা রেখেই প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। ফকিরেরপুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় কাকরাইল থেকে ফকিরেরপুল, পল্টনমুখী সব ধরনের যান চলাচল। বিক্ষুব্ধদের মধ্যে কয়েকজন হেলমেটধারী আচমকা ভিক্টোরি হোটেলের সামনে পার্ক করা পুলিশের একটি ডাবল কেবিন পিকঅ্যাপ ভ্যান ও প্রাইভেটকারে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষুব্ধরা রাস্তায় চলাচলকারী কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেলের গ্লাস ভাঙচুর করে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। রণক্ষেত্র তখন পুরো এলাকা। বেলা ২টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা থেমে থেমে ছোট ছোট মিছিল বের করে। নাইটিঙ্গেল মোড়ে কিছু নেতা-কর্মী রাস্তায় বসে স্লোগান দিতে থাকে। বিকাল ৫টা নাগাদ পুরো এলাকায় যানবাহন চলাচল ও জীবনযাপন স্বাভাবিক অবস্তায় ফিরে আসে। তবে মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক কাজ করছিল। অনেকে সংঘর্ষের পর বন্ধ দোকানপাট আর খোলেননি। বেলা ৩টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বিনা উসকানিতে ইস্যু তৈরির জন্য পুলিশের ওপর হামলা করা হয়েছে। পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিল। হঠাৎ বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশকে প্রতিপক্ষ না ভেবে শান্তিপূর্ণভাবে বিএনপি নেতা-কর্মীদের নিজ নিজ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘দুই দিন ধরে বিএনপির মনোনয়ন বিক্রি শান্তিপূর্ণ ছিল। আমাদের ৮-১০ জন পুলিশ সদস্য সেখানে ছিলেন। আমাদের পক্ষ থেকে বারবার রাস্তা খালি করে যান চলাচল করতে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছিল। আজকে (বুধবার) বেলা সোয়া ১টার দিকে হাজার হাজার নেতা-কর্মী অবস্থান নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। আমাদের সাত-আটজন পুলিশ সদস্য নেতা-কর্মীদের রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা অনুরোধ না শুনে পুলিশ সদস্যদের ওপর চড়াও হয়। তখন পাশে থাকা আমাদের প্যাট্রল টিম এগিয়ে আসে। তারাও হামলার শিকার হয়। আমাদের ১৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।

আহত পুলিশদের দেখতে হাসপাতালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : সন্ধ্যায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আহত সদস্যদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়ে বের হওয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। শুধু হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তারা পুলিশের দুটি গাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে পুলিশের গাড়িতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা হামলা করেছে।’ এ সময় পুলিশের আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী এবং ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর