বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়া কি ভোট করতে পারবেন?

আরাফাত মুন্না

খালেদা জিয়া কি ভোট করতে পারবেন?

নিম্ন আদালতে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তির সাজার ওপর উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ না থাকলে সংসদ নির্বাচনে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করার নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অর্থাৎ সাজার ওপর স্থগিতাদেশ ছাড়া উচ্চ আদালতে আপিল চলমান থাকলেও কেউ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এখন দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, এ প্রশ্নই ঘুরছে সব মহলে। খালেদার নির্বাচন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে আইনজীবীদের মধ্যেও। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মতে, মনোনয়নপত্র গ্রহণের এখতিয়ার একমাত্র রিটার্নিং অফিসারের হাতেই। দণ্ড স্থগিত না হয়েও ইতিপূর্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণের নজির রয়েছে। তাই খালেদা জিয়ারও নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই বলেই মনে করেন তারা। অন্যদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ দেখছেন না সরকার সমর্থক আইনজীবীরা। দুদকের আইনজীবী মনে করেন, খালেদা জিয়া নির্বাচনের অযোগ্য। তারা বলছেন, দুটি মামলায় খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর মধ্যে একটি মামলায় তারা আপিল করলে হাই কোর্ট খালেদা জিয়ার সাজা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই তার নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ৬৬(২গ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নৈতিক স্খলনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছর কারাবাসে থেকে মুক্তির পর পাঁচ বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে যোগ্য হবেন না। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে প্রার্থীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা আছে যে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো আদালতে দুই বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।’ তবে আদালতের এমন রায়ের বিরুদ্ধে কেউ উচ্চ আদালতে আপিল করলে সেই ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে আইনে কোনো ব্যাখ্যা নেই। এ সুযোগটিই কাজে লাগাতে চান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। জানা গেছে, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জমা হওয়া মনোনয়নপত্র বৈধ কি অবৈধ, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রিটার্নিং অফিসারের। রিটার্নিং অফিসার কারও মনোনয়নপত্র অবৈধ বলে বাতিল করলে এর বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারবেন। কমিশনও আবেদন বাতিল করলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হাই কোর্টেও আবেদন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হয় নির্বাচন কমিশনকে।

জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে কারও দুই বছর বা ততোধিক সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারাবেন। বিএনপি চেয়ারপারসনকে যে অপরাধে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেটা নৈতিক স্খলনজনিত কি না, রায়ের অনুলিপি পেলেই তা স্পষ্ট হবে।’ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সাজা স্থগিতের প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন না খালেদা জিয়ার এই আইনজীবী। তিনি বলেন, সাজা বহাল অবস্থায়ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের নজির রয়েছে। আপিল আবেদন দাখিল করেও অনেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অনেকেই সাজা মাথায় নিয়ে নির্বাচন করেছেন। ম্যাডামের পক্ষে আমরা আবেদন করব এবং ইনশা আল্লাহ তিনিও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হবে কি না, এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রিটার্নিং অফিসারের। আমরা রিটার্নিং অফিসার বরাবর মনোনয়নপত্র দাখিল করব। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন।’ সাজা স্থগিত না হলে মনোনয়নপত্র বাতিল করার বিষয়ে ইসির বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারে না।’ তাদের এ বক্তব্য বেআইনি বলেও দাবি করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন।

এ বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, রাজনৈতিক কারণেই নির্বাচনের বছরে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এখন সবকিছুই হয় সরকারের ইচ্ছায়। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া দেশে নির্বাচন হবে না। তিনি যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, সেজন্য সর্বাত্মক আইনি লড়াই চালানো হবে। দুটি মামলা (অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) নিয়েই তারা কাজ করছেন।

এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণের সুযোগ দেখছেন না সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, দুটি দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছর সাজা পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সংবিধান অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধে দুই বছর কারাদণ্ড হলেই তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। তার তো হয়েছে ১৭ বছর। সাজা স্থগিত হলে নির্বাচনের সুযোগ থাকে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখন প্রশ্ন হলো, তিনি (খালেদা জিয়া) একটাতে ১০ বছর এবং আরেকটাতে সাত বছর সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি আপিল করার সুযোগ পেলেও আপিল শুনানি করে নির্দোষ প্রমাণের বিষয়টি তো সময়সাপেক্ষ। কাজেই এই পরিস্থিতিতে সংবিধানে যে বিধান আছে, তাতে তিনি অযোগ্য হবেন। ফলে নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি পারবেন বলে আমার মনে হয় না।’ তিনি বলেন, আপিল করতে হলে সার্টিফায়েড কপি নিতে হবে। হাই কোর্টে আপিল শুনানি করতে হবে। এরপর আবার আপিল বিভাগ আছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময়ের মধ্যে (২৮ নভেম্বর) এসব প্রক্রিয়া শেষ করা অসম্ভব বলেই মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। সাজা থেকে খালাস না পেলে তিনি নির্বাচন করত পারবেন না। বিষয়টি সংবিধানে উল্লেখ আছে।’ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে নির্বাচন সম্ভব কি না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আপিল করলে বিষয়টি আদালতের ওপর বর্তায়। সে ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত আদালতই দেবে।

৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত। ওই দিন আদালত থেকেই তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে রাখা হয়েছে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি কক্ষে। এ মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন হাই কোর্টে আপিল করলে খালেদা জিয়ার সাজা বেড়ে ১০ বছর কারাদণ্ড হয়। এদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও খালেদা জিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

সর্বশেষ খবর