শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

শীর্ষেন্দুর কথা

ইমদাদুল হক মিলন

শীর্ষেন্দুর কথা

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় হাসতে হাসতে বললেন, কাক হয়ে কাকের মাংস খাওয়া ভালো না, মিলন। নব্বই দশকের গোড়ার দিককার কথা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এসেছেন ঢাকায়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। পাঠকের মুখোমুখি লেখক। হলভর্তি শীর্ষেন্দুর পাঠক। বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। শীর্ষেন্দু হাসিমুখে, রসালো ভঙ্গিতে কথা বলে মাতিয়ে দিচ্ছেন। এক সময় আমি উঠে দাঁড়ালাম। একটা প্রশ্ন করলাম। প্রশ্নটা শুনে শীর্ষেন্দু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আপনার নাম? নাম বললাম। তিনি হৈ হৈ করে উঠলেন। আরে তুমি তো খুব বিখ্যাত লেখক। সুনীলের কাছে তোমার কথা শুনেছি। সমরেশের কাছে শুনেছি। আর আমার বন্ধু বরেণ গঙ্গোপাধ্যায় তো তোমার খুব ভক্ত। আমি তোমার বেশ কিছু লেখা পড়েছি। এই অনুষ্ঠানে তুমিও কাক আমিও কাক। কাক হয়ে কাকের মাংস খেয়ো না। তোমার প্রশ্ন করার দরকারই নেই। খুব মজা হলো সেই বিকেলে। পরদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেই শীর্ষেন্দুকে নিয়ে আরেকটি অনুষ্ঠান হলো। সঞ্চালকের দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। এইভাবে ব্যক্তি শীর্ষেন্দুর সঙ্গে আমার পরিচয় এবং অন্তরঙ্গতা। তার লেখার সঙ্গে পরিচয় তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সাল থেকে। শীর্ষেন্দুর প্রথম উপন্যাস পড়েছিলাম ‘উজান’। পড়ে এমন এক ঘোর তৈরি হলো নিজের মধ্যে শীর্ষেন্দু আমার নেশা হয়ে দাঁড়ালেন। তার ঘোর থেকে বেরুতেই পারি না। তার হাতে যেন জাদুর কলম। আমাকে সম্মোহিত করে রাখছেন। যেখানে তার যত লেখা পাই গোগ্রাসে পড়ি। কোনো কোনো লেখা দুবার তিনবারও পড়া হয়। আশ্চর্য সব গল্প, আশ্চর্য সব উপন্যাস। এমন একটা মায়াবী জগৎ তৈরি করেন লেখার মধ্যে, সেই মায়া কাটানো যায় না। সাপ, মুনিয়ার চারদিক, ক্রীড়াভূমি, দৈত্যের বাগানে শিশু, ডুবুরী, বন্ধুর অসুখ, টাংকিসাফ, বৃষ্টিতে নিশিকান্ত এরকম কত কত গল্প। তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ পড়ে কয়েকদিন বিহ্বল হয়ে থাকলাম। পড়লাম তার ‘নয়নশ্যামা’ ‘শূন্যের উদ্যান’ ‘বৃষ্টির ঘ্রাণ, ‘পাপ’। তারপর ‘দেশ’ পত্রিকায় শুরু হলো তার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘পারাপার’। তারপর ‘যাওপাখি’, ‘দূরবীণ’ ‘মানবজমিন’ পড়তে পড়তে ঢুকে যাই এক অপার্থিব জগতে। লক্ষ্য করি এই লেখক চলমান পৃথিবীর অভ্যন্তরে আরেক অলৌকিক জগতের সন্ধান করেন। সেই মায়াবী জগতে টেনে নেন পাঠককে। পরে চ্যানেল আইয়ের এক অনুষ্ঠানে তার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এই প্রশ্নটা আমি করেছিলাম। চলমান জগতের ভিতরে তার অপার্থিব জগতের অনুসন্ধান। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি লেখক বলেই ব্যাপারটা সুন্দরভাবে ধরতে পেরেছ। হ্যাঁ, ওরকম এক অনুসন্ধান আমার লেখায় থাকে। ঠাকুরের সংস্পর্শে গিয়ে এই জগতের সন্ধান আমি পেয়েছি।’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দর্শনে দীক্ষিত। এক জীবনে প্রবল হতাশায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন। আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন। সেই হতাশা থেকে ঠাকুর তাকে উদ্ধার করেছিলেন, বাঁচার পথ দেখিয়েছিলেন। এখনো তিনি আপাদমস্তক ডুবে আছেন অনুকূলচন্দ্রের দর্শনে। এক ধরনের সাত্ত্বিক জীবনযাপন করেন। সেই যে পরিচয় হলো তারপর ঢাকায় এলেই শীর্ষেন্দুদা আমার খোঁজখবর করেন। পাবনায় ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের আশ্রমে বছর দুবছরে একবার আসেন। কখনো কখনো ওদিক দিয়ে ফিরে যান কলকাতায়। কখনো কখনো আসেন ঢাকায়। শাঁখারি বাজারে ঠাকুরভক্তদের সঙ্গে থাকেন। সাতানব্বই-আটানব্বই সালের দিকে একদিন এলেন আমার গেন্ডারিয়ার ফ্ল্যাটে। আমার মেয়ে দুটো ছোট। দুজনই শীর্ষেন্দুর মহাভক্ত। কারণ ততদিনে বাংলা শিশুসাহিত্যের চেহারাটা একা অনেকখানি বদলে দিয়েছেন শীর্ষেন্দুদা। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’, ‘গোসাইবাগানের ভূত’ আর অদ্ভুত অদ্ভুত সব কিশোরগল্প লিখে শিশু-কিশোরদের মাতিয়ে দিয়েছেন। ভয়ের ভূত থেকে শিশু-কিশোরদের মুক্তি দিয়ে এমন এক ভূত তিনি বাংলাসাহিত্যে আমদানি করলেন যে ভূত কিছুতেই কাউকে ভয় দেখাতে পারে না। ভয়ের ভূত হয়ে উঠল মজারভূত। বন্ধুভূত। তখনো মোবাইল আসেনি দেশে। পাশের ফ্ল্যাট থেকে ক্যামেরা ধার করে এনে শীর্ষেন্দুদার সঙ্গে বেশ কয়েকটা ছবি তুলল আমার মেয়েরা। স্ত্রী প্রচুর খাবার-দাবার দিয়েছেন টেবিলে। শীর্ষেন্দুদা কিছুই মুখে দিলেন না।

দুপুর হয়ে গেছে। তার কাঁধে ঝোলা। ঝোলা থেকে আপেল বের করে খেলেন, কমলা বের করে খেলেন। আমার স্ত্রী অবাক। কারণ টেবিলেও এই ফলগুলো দেওয়া হয়েছে। রহস্যটা আমি জানতাম। স্ত্রীর কানে কানে বললাম শীর্ষেন্দুদা বাইরের খাবার খান না। তার যে মন খারাপ হয়েছে এটা শীর্ষেন্দুদা খেয়াল করলেন। হাসিমুখে বললেন, তুমি মন খারাপ কর না বউমা। আমাকে এক কাপ রং চা দাও। বাইরের অন্য খাবার আমি খেতে পারি না।

এ ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর এক দুপুরে তিনি আমার মগবাজারের ফ্ল্যাটে এলেন। সঙ্গে আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি ও আবৃত্তিকার, অভিধান রচয়িতা রবিশংকর মৈত্রী। এসেই শীর্ষেন্দুদা বললেন, তোমার বাড়িতে চান করতে এলাম, মিলন। আমি খুশি মনে বাথরুম দেখিয়ে দিলাম। আমার স্ত্রী ধোয়া টাওয়েল বের করে দিলেন। শীর্ষেন্দুদা সেই টাওয়েল ধরলেন না। নিজের ঝোলা থেকে একটা গামছা বের করে বাথরুমে চলে গেলেন। এবারও স্ত্রীকে আমার বলতে হলো, শীর্ষেন্দুদা এ ধরনের জীবনযাপনই করেন। তারপর কলকাতায় তার সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। একসঙ্গে বিভিন্ন সাহিত্যের অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসে কথা বলেছি। তিনি কথা বলেন তার লেখার মতোই অতি আকর্ষণীয় এবং রসালো ভঙ্গিতে। তার কথা শোনার জন্য হাজার দর্শক পিনপতন নীরবতায় আছন্ন হয়। তার জীবনযাপনের সঙ্গে তার লেখার যেন কোনো মিলই নেই। তিনি জীবনযাপন করেন সন্তের মতো, লেখেন পৃথিবীর চূড়ান্ত আধুনিক মানুষটির মতো। সন্তরাও নিশ্চয়ই আধুনিক। শীর্ষেন্দুকে দেখে আমি তা টের পাই। এবারের ঢাকা লিট ফেস্টের সর্বশেষ আকর্ষণ ছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ হল কানায় কানায় পূর্ণ। মেঝেতেও বসে গেছেন অনেকে। হলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ-সাতশ’ মানুষ। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আমি। ঘণ্টাখানেক তার সেই অসামান্য বাচনভঙ্গিতে কথা বলে গেলেন শীর্ষেন্দুদা। করতালির পর করতালিতে মুখর হচ্ছে হল। একজন লেখকের জন্য পাঠকের এমন আকুলতা অনেকদিন দেখিনি আমি। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শীর্ষেন্দুদাকে নিয়ে বেরুনোই যাচ্ছিল না। হলের বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। হাজারখানেক মানুষ তো হবেই। লিট ফেস্টের কর্মীরা সামাল দিতে পারছে না। অটোগ্রাফের জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ডাকতে হলো। পুলিশ এসে ভিড় সামাল দিয়ে শীর্ষেন্দুকে গাড়িতে তুলে দিল। তার গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে আর আমার মনে পড়ছে শীর্ষেন্দুদার ‘পারাপার’ উপন্যাসের শেষ কয়েকটি লাইন। ‘দুঃখময় পৃথিবীতে মানুষ কত পুরনো হয়ে গেল। তবু মানুষের জন্ম এখন কী রোমাঞ্চকর।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর