শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
খোলা মত

ড. কামালকে সংবিধান প্রণেতা বলা বিভ্রান্তিকর তিনি ৩৪ জনের একজন

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

আজকাল অনেকেই বলে থাকেন ড. কামাল হোসেন সংবিধান প্রণেতা। যারা এমনটি বলেন তাদের মধ্যে অনেক জ্ঞানী গুণীজনও রয়েছেন অথচ ড. কামাল যে এককভাবে সংবিধান প্রণেতা নন এ সত্য কথাটি অনেকের মন থেকে মুছে গেছে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ড. কামাল নিজেও কখনো এ কথার প্রতিবাদ করে সঠিক তথ্যটি প্রকাশ করেন না। তিনি বরং এ ব্যাপারে দুঃখজনক নীরবতা অবলম্বন করে এমন ভাব দেখান যে, তিনি একাই সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তনের পর পরই কালক্ষেপণ করে যথাশিগগির সম্ভব সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে গণপরিষদের ৩৪ জন সদস্য নিয়ে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের নিমিত্তে একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটিতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যেহেতু ড. কামাল তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন, তাই তাকে করা হয়েছিল ওই কমিটির সভাপতি, পদাধিকার বলে। শুধু ৩৪ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করেই বঙ্গবন্ধু ক্ষান্ত হননি, তিনি ওই ৩৪ সদস্যকে প্রতিনিয়ত তথ্য, উপদেশ, নির্দেশনা গাইডলাইন, মৌলিক তত্ত্বসমূহ প্রদান করে নিজে প্রত্যক্ষভাবে খসড়া প্রণয়নে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে আইনজ্ঞ না হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধানের ওপর তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে বঙ্গবন্ধু বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার হোসেন শহীদ  সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠতম, সার্বক্ষণিক সহচর এবং সহকর্মী ছিলেন। তাই সংবিধানের ওপর সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জ্ঞান বঙ্গবন্ধুকেও আলোকিত করেছিল, এটাই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে অধ্যাপক আবু সায়ীদ, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম এবং প্রয়াত সুরঞ্জিত বাবুর কাছ থেকে শুনেছি যে তারা সংবিধানের ওপর বঙ্গবন্ধুর জ্ঞানের পরিধি দেখে অবাক হতেন। সার্বজনীন মানবাধিকারের বিধানগুলো এবং অন্যান্য সাংবিধানিক তথ্য বিরল স্মৃতিশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্থ ছিল।

উক্ত ৩৪ সদস্যের অন্যতম, অধ্যাপক আবু সায়ীদ জানিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু নিজ উদ্যোগে ৬টি দেশের সংবিধানের কপি হস্তগত করে সেগুলো থেকে বিভিন্ন উপাদান বাছাই করে ৩৪ জনকে প্রদান করেন এবং এই মর্মে নির্দেশনা দেন সেই বাছাইকৃত উপাদানগুলোর ওপরে যেন বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। শুধু তাই নয়। তিনি অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ভাষায় বলে দিয়েছিলেন যে চার মূল নীতির ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সে চার চেতনাই প্রাধান্য পাবে সংবিধানে। তিনি নিজে চারটি মূল নীতির ব্যাখ্যাও প্রদান করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে পাশ্চাত্যে গির্জা এবং সমাজের মধ্যে যে দেয়ালের কথা বুঝানো হয় বঙ্গবন্ধু সে তত্ত্ব পরিহার করে বলে দিয়েছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্ম চর্চায় রাষ্ট্রের সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। এই মূল নীতির প্রতি অবিচল থেকেই তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে তার কঠোর অনীহার কথা প্রকাশ  পেয়েছিল ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর গণপরিষদে সংবিধানের ওপর তার ভাষণে যেখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান সবাই তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না।

আজীবন গণতন্ত্রের প্রহরী হিসেবে তার মানস জগতে যে ধ্যান-ধারণা কাজ করেছে তা হলো এই যে, যেসব অধিকার বিনে মানুষ মানুষের মতো বাঁচতে পারে না, সেগুলোর সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকতে হবে এবং সে উদ্দেশ্যে তিনি ৩৪ সদস্যকে বলেছিলেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণার সবকটিকেই স্থান দিতে হবে সংবিধানে। খসড়ায় তাই তৃতীয় অংশে স্থান পেয়েছে ১৮টি মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা এবং সেগুলো হাই কোর্টের মাধ্যমে প্রয়োগের বিধান। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বঙ্গবন্ধু নিকৃষ্টতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভুক্তভোগী ছিলেন। সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় বঙ্গবন্ধু প্রাধান্য দিয়েছিলেন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার। তিনি নিজে প্রতিনিয়ত এই ৩৪ সদস্যের কমিটির প্রতিটি সদস্যের খসড়া এবং অগ্রগতি নিরীক্ষা করে অবশেষে খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পূর্বে ভালুকা এলাকার তোকলা নামক এক জায়গায় এক রেস্ট হাউসে সেই ৩৪ সদস্যের সঙ্গে বসে (সূত্র বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদ, যিনি নিজেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে উপস্থিত ছিলেন) খসড়ার সব দিক পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনে সংশোধন করেন। ওই ৩৪ জন সদস্য যে মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় তার নির্ধারণ করা ছক অনুযায়ী এবং তত্ত্বাবধানে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন এবং ওই ৩৪ জন সদস্যের প্রত্যেকেরই সংবিধান প্রণয়নে অবদান ছিল, তা বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের ভাষণ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে, যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ সেই ৩৪ জন সদস্যকে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে শাসনতন্ত্র রচনা করেছেন। ১১ এপ্রিল তারিখ থেকে আমরা শাসনতন্ত্র কমিটি গঠন করি।’ এ ছাড়া কয়েকজন অধ্যাপকও সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে অবদান রেখেছেন বলে, বঙ্গবন্ধুর ৪ নভেম্বরের ভাষণ থেকে জানা যায়। সেই সময়ের গণপরিষদের বিবরণী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় খসড়া প্রণয়নে স্বতন্ত্র সদস্য শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন, বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন, যার জন্য বঙ্গবন্ধু সুরঞ্জিত বাবুর প্রশংসা করেছেন। তাছাড়া ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম সাহেবেরও বিশেষ অবদান ছিল এই অর্থে যে ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া তিনি রচনা করেছিলেন যেটি আমাদের সংবিধান অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী সংবিধানের ভূমিকায় ছিল। এটি আমাদের সংবিধান প্রণয়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট এই ঘোষণাপত্রকে genesis of the constitution বলে আখ্যা দিয়েছে। এক কথায় ওই ৩৪ সদস্যের কারও ভূমিকাই ড. কামাল থেকে কম ছিল না। কমিটির সভাপতি হিসেবে তার মূল দায়িত্ব ছিল কমিটির সভা তলব করা, মুলতবি করা, সভার আলোচ্য সূচি নির্ধারণ করা, পদ্ধতি প্রণয়ন করা, সদস্যদের কাছ থেকে খসড়া গ্রহণ করে তা সন্নিবিষ্ট করা ইত্যাদি যা সাধারণত সভাপতিদের কাজ। আমরা যদি মুখে মুখে বলতে থাকি যে ড. কামালই সংবিধান প্রণয়ন করেছেন তা হলে এই মারাত্মক ভুল তথ্যটি ইতিহাসে স্থান পেয়ে যাওয়ার ভয় থাকবে যার ফলে ইতিহাস বিকৃত হবে, নতুন প্রজন্ম ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিচলিত হয়ে ভাববে ড. কামাল একাই সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। একই সঙ্গে সংবিধান প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ভূমিকাকেও খাটো করা হবে। তাই এই ভ্রান্ত উচ্চারণকে আমাদের পরিহার করতে হবে, সত্যের স্বার্থে সঠিক ইতিহাস রচনার স্বার্থে, ৩৪ জনের সবার অবদানের স্বীকৃতির স্বার্থে এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বের কথা মনে রাখার জন্য। কয়েকদিন পূর্বে জাতীয় সংসদের মাননীয় ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিঞা এই ভ্রান্তিকর, বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যের প্রতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন যে, ড. কামালকে এককভাবে সংবিধান প্রণেতা বলা একেবারেই ঠিক নয়। তার এই সময়োচিত মন্তব্য সবাইকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।

সর্বশেষ খবর