শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দেখেছি আনন্দাশ্রু, স্বজন হারানোর বেদনা

কর্নেল জাফর ইমাম (অব.) বীরবিক্রম

দেখেছি আনন্দাশ্রু, স্বজন হারানোর বেদনা

বিজয়লগ্নে বাংলার জনপদগুলোতে চলছিল উল্লাসের মিছিল। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান ৩০ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে হারানোর বেদনা। আকাশ-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। সেদিন ছিল না দলীয় পরিচয়। স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তি ছিল ঐক্যবদ্ধ। সবার একটাই স্বপ্ন ছিল— নিজের মতো করে নিজেদের দেশটা গড়ব। থাকবে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ। সেই উচ্ছ্বাস আর আবেগ আমাদের সব ধরে রাখতে হবে। আজ তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শহীদদের স্বপ্ন-সাধ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কোনো গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর ঐক্যের পথ রাখতে হবে উন্মুক্ত। সজাগ থাকতে হবে। আমাদের কোনো ভুলের জন্য জাতি যেন দ্বিধাবিভক্ত না হয়ে পড়ে। বিজয়ের মুহূর্তে সবার একটাই আশা ছিল— কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গড়ব। যেখানে থাকবে না কোনো হানাহানি বা ক্ষমতার লড়াই। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে যেভাবেই স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু যারা জীবনবাজি রেখে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করা উচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রায় চার হাজার সেনা অফিসার ও সৈনিক আমাদের স্বাধীনতার জন্য তাদের বুকের রক্ত দিয়ে বাংলার মাটি রঞ্জিত করেছিলেন। তাদের সম্মান দিতে আমরা কার্পণ্য করি কেন? শুনেছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতীয় শহীদ পরিবারের সদস্যরা বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পান না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় রয়েছে। আমাদের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ভারত থেকে পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংগ্রহ করে মরণোত্তর সংবর্ধনা দেওয়া, তাদের নামে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিদেশিদের সম্মাননা দিচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর যারা হতাহত হয়েছেন এবং যারা বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রেখেছেন তাদের সম্মাননা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেককে দিয়েছে।  আরও ১৫০০ ভারতীয় সেনা সদস্যের তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এটা সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ উদ্যোগ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন গ্রুপে বা রাজনৈতিক দলে থাকাটাই স্বাভাবিক। যেখানেই থাকুক না কেন সবাই দেশপ্রেমিক। দলীয় কারণে তাদের বিতর্কিত করা সমীচীন নয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, অহঙ্কার এবং গর্ব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে চেতনা নিয়ে জীবনবাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, সে চেতনা যেন আজ ম্রিয়মাণ। মনে রাখতে হবে যে জাতি বীরদের সম্মান দেখাতে জানে না সে জাতিতে বীর জন্মাতে পারে না। শুধু বিজয় আর স্বাধীনতা দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সবাই সোচ্চার হয় এবং আনন্দ-উল্লাস করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত এ বিজয়ের আনন্দ হতে হবে চিরন্তন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে। যেদিন এ চেতনা হারিয়ে যাবে সেদিন এ আনন্দ-উল্লাস ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হবে। এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হবে হুমকির সম্মুখীন। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে থাকতে হবে আপসহীন। এ চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হলে জানতে হবে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রেক্ষাপট। এই বিজয় তথা স্বাধীনতা কারও দান-অনুদান বা কৃপায় আসেনি। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে আমরা ’৭০-এর নির্বাচনে আসলাম। সফল এই সংগ্রাম থেকে আমরা পদার্পণ করলাম ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে। এই দীর্ঘ সংগ্রাম ও যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে ও নেতৃত্বে। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল সফল দীর্ঘ সংগ্রামের সমাপনী ও কৌশলে স্বাধীনতা ঘোষণা এবং একটা জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার মূলমন্ত্র। এ ভাষণের পরদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের কাছে এই বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, ‘বঙ্গবন্ধু কৌশলে আসলে স্বাধীনতাই ঘোষণা করেছেন’। স্বাধীন বাংলা সরকারের অধীনে, যে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তাও বঙ্গবন্ধুর নামে। স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধু আর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। যদি বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্ট না দেখানো হতো যুদ্ধকালীন ভারতের সার্বিক সহযোগিতায় যেমন ঘাটতি দেখা দিত তেমনি বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতেও ভিন্ন প্রভাব পড়ত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছাড়া ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব হতো না। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন আমাদের সঠিক ইতিহাসের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শানিত ও সমুন্নত রাখতে হবে। তাহলেই শুধু এ বিজয়ের আনন্দ-উল্লাস হবে যথার্থ। এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ কে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নির্দেশ প্রদান করেছিলেন এই বলে যে, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত করা।’ মানেক শ খুব বিনয়ের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন ‘ইহা সঠিক সময় নয়। এখন আক্রমণ করলে আমরা পরাজিত হব।’ যদি সেদিন মানেক শ ইস্ট পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশ আক্রমণ করে দখল করতে পারতেন তাহলে আমরা কি আজ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি বলতে পারতাম? আমাদের বিজয়ের উল্লাস আনন্দ ও অহঙ্কারে বিরাট ঘাটতি দেখা দিত। ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে গোটা পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। কিন্তু এর আগে ১০ নভেম্বর আমার নেতৃত্বে পরশুরাম ও চিতলিয়ায় দুটি ঘাঁটিতে পরিচালিত অভিযানে ৭২ জন পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে প্রথম একমাত্র আত্মসমর্পণ। সাত শতাধিক সৈন্য নিয়ে তাদের এ ঘাঁটি পরিচালিত হতো। মানেক শ সর্বশেষ ডিসেম্বর ’৭১ এ ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মতি দেন এই বলে যে, আক্রমণের জন্য এখন সঠিক সময়। তাই ইন্দিরা গান্ধী ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। অনুলেখক : শফিকুল ইসলাম সোহাগ

সর্বশেষ খবর