সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পূর্বাচলের যানজট লাঘবে ইউলুপ নির্মাণের সুপারিশ

শিমুল মাহমুদ ও জিন্নাতুন নূর

রাজধানীর পূর্বাচল নতুন উপশহর প্রকল্প ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অব্যাহত যানজট লাঘবে একাধিক ইউলুপ তৈরির সুপারিশ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলেছেন, নগরীর সবচেয়ে সুপরিকল্পিত পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে সড়ক ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়াই ইউলুপ ব্যবহার করে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ যেন নিরাপদে যার যার গন্তব্যে যেতে পারেন সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ ঢাকা শহরের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষার জন্য এই ইউলুপ কাজে আসবে। আর ইউলুপ তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির ট্রাফিক ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট (টিআইএ) রিপোর্ট তৈরি করে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলসহ আশপাশের মানুষের চলাচলের জন্য ‘সার্ভিস রোড’ও চালু করার সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে পূর্বাচল তিনশ ফুট রাস্তাটিতে অবাধ যান চলাচল সক্রিয় থাকবে। বর্তমানে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বালু ব্রিজ, কাঞ্চন সেতু হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা পর্যন্ত হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের চাপে মাঝে মাঝেই তিনশ ফুট সড়কটির বিভিন্ন অংশে যানজট তৈরি হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই সড়কটির আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দা, যাদের প্রধান সড়ক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই তারা শুধু সার্ভিস রোড ব্যবহার করেই যাতায়াত করতে পারবেন। সার্ভিস রোড টু সার্ভিস রোড ইউলুপ তৈরি করা হলে মূল সড়কটিতে কোনো বাধা ছাড়াই যানবাহন চলতে পারবে। উল্লেখ্য, রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায় দুটি ইউলুপ তৈরির ফলে রামপুরা ব্রিজ এলাকা ও বাড্ডার যানজট কমে গেছে। পাশাপাশি রামপুরা থেকে রোকেয়া সরণি সড়কটি অনেকটা যানজট মুক্ত হয়েছে। এই সড়কে যাতায়াতে এখন সময় লাগছে আগের চেয়ে কম। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পূর্বাঞ্চলে ভবিষ্যতে পরিকল্পিত আবাসন এলাকা গড়ে উঠবে। এখন মাত্র ১ শতাংশ মানুষ সেখানে বসবাস করছে। কিন্তু এরপরও তিনশ ফুট হয়ে পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার সড়কটিতে প্রাইভেট কার, মালবাহী ট্রাক, পিকআপ ও বাসের চাপে এখন মাত্রাতিরিক্ত যানজট তৈরি হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় এই যে, ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ আবাসন এলাকা তৈরি হলে সেখানে যখন মানুষ পুরোপুরিভাবে বসবাস শুরু করবে তখন যানজট আরও বৃদ্ধি পাবে। আর এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাস্তাটির গুরুত্বপূর্ণ দু-একটি পয়েন্টে ইউলুপের মতো স্থাপনা তৈরি করা যেতে পারে। বিশেষত ঢাকা শহরের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষার জন্য এই ইউলুপ কাজে আসবে। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলসহ আশপাশের মানুষের চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড চালু করা যেতে পারে। সাধারণত একটি এলাকার পাশ দিয়ে মহাসড়ক চলে গেলে সে এলাকার মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করা হয়। তিনশ ফুট সড়কের পাশেই যাদের ঘরবাড়ি তারা ঘর থেকে বের হয়েই প্রধান সড়কে উঠবেন এমন না। এজন্য বিকল্প হিসেবে সার্ভিস রোড ব্যবহার করা যেতে পারে। একইসঙ্গে এই সড়কে লম্বা দূরত্বে যাতায়াতের জন্য এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামোর নির্মাণও সড়কের ওপর যানজটের চাপ কমাবে। তিনি আরও বলেন, এই সড়কটির সেবামূলক স্থাপনাগুলোর পাশে সার্ভিস রোড করা হলে মানুষ উপকৃত হবেন। এ ছাড়া এই সড়কটি দুই পাশের মূল সড়ক থেকে উঁচু করে তৈরি করতে হবে। আর উঁচু সড়কের নিচের অংশ দিয়ে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, পূর্বাঞ্চল নতুন শহর গড়ে ওঠার খবর যখন আমরা জানতে পারলাম তখন বেশ আশান্বিত ছিলাম এই ভেবে যে শহরের পূর্ব প্রান্তে নতুন শহর গড়ে উঠছে। কারণ, শহরের ভিতরে আমরা তিনশ ফুট সড়ক পাই না। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে এই প্রশস্ত সড়কটি আমাদের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসবে। অর্থাৎ তিনশ ফুট সড়কে গেলে অন্তত আমাদের শহরের ভিতর যানজটের যে চাপ সহ্য করতে হয় তা আর হবে না। কিন্তু গত দুই বছরে আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানে যে পরিমাণ ট্রাফিক, যানজট বৃদ্ধি পেয়েছে তা সামলাতে এখনই ট্রাফিক পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এই এলাকায় যখন পরিপূর্ণভাবে আবাসন ব্যবস্থা চালু হবে তখন আরও নানা রকম কর্মব্যস্ততা তৈরি হবে। আর এই অবস্থায় যখন পূর্বাঞ্চলকে ঘিরে পরিপূর্ণ শহর গড়ে উঠবে তখন এই যানজটের চাপ নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুঃখজনক যে, শহরের ট্রাফিক যেখানে আমরা সামলাতে পারছি না সেখানে আন্তজেলা ট্রাফিক পরিবহন ব্যবস্থাও শহরের মধ্য দিয়ে (তিনশ ফুট সড়ক দিয়ে) পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশেই শহরের মধ্য দিয়ে আন্তজেলা পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠার নজির নেই। লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে, বিশ্বরোডে ফ্লাইওভারের শেষে যাত্রীবাহী যানগুলো থেকে নেমে যাত্রীরা সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও সড়কের যানজট বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।  স্বনামধন্য স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিনশ ফুট সড়কটি কাঞ্চন ব্রিজের কাছে যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে সেখানে এটি ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো আকৃতি তৈরি করেছে। আর এই আকৃতি কার্যত এক ধরনের বাধা তৈরি করে। যেমন— এখান থেকে একজন বাঁয়ে বা ডানে যেতে পারবেন ঠিকই কিন্তু ডানে যাওয়ার জন্য কোনো ইউলুপ বা ওভারপাস নেই। অর্থাৎ এই ইন্টারসেকশন এক ধরনের ‘বটলনেক’-এর মতো হয়ে গিয়েছে। এজন্য শহরের এই রাস্তার ইন্টারসেকশন, ট্রাফিক নোটস এগুলোকে উন্নত করতে ইউলুপ করে যানজট সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু তিনশ ফুট সড়কটি যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে তার উন্নয়নের বিষয়গুলো এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত রয়ে গেছে। যা এক ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। এ ছাড়া পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য শহরের সঙ্গে এই সড়কটির এক ধরনের সংযোগ তৈরি হয়েছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে আমাদের নগর পরিকল্পনাতেও সমস্যা আছে। বিশেষ করে শহরের মাঝখানে কীভাবে পণ্য পরিবহন ও খালাস হবে সেটি পরিকল্পনামাফিক গড়ে ওঠেনি। তিনি আরও বলেন, আমরা ছাত্রাবস্থা থেকেই ইস্টার্ন বাইপাসের কথা শুনে আসছি কিন্তু আজও ইস্টার্ন বাইপাসের বা এর মতো কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা দেখতে পাইনি। তিনশ ফুট এখন আন্তজেলার জন্য যাত্রী বা পণ্য পরিবহনের অন্যতম রুট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি যানজট আরও বৃদ্ধি করছে।

তবে তিনশ ফুট সড়কে নির্দিষ্ট করে ঠিক কোথায় ইউলুপের মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন তা জানতে চাইলে মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, এজন্য গবেষণা বা জরিপ প্রয়োজন। সড়কটির কোথায় জনসংখ্যা বেশি এবং যানজটের ধরন ইত্যাদি তথ্য বের করতে হবে। যা নগর পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এজন্য নগর পরিকল্পনাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও স্থপতিদের নিয়ে এ বিষয়ে জরিপ হওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের একটি জরিপ পরিচালনা করার কথাও ছিল। যারা এটি নিয়ে কাজ করছে তাদের এরই মধ্যে এই জরিপ সম্পন্ন করার কথা। আর এই টিআইএ রিপোর্ট মেনে তিনশ ফুট সড়কের ওপর ইউলুপ তৈরি করা হলে যানজট কমানোর ক্ষেত্রে তা কার্যকরী সমাধান হতে পারে।

সর্বশেষ খবর