বুধবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভিকারুননিসা ছাত্রীর আত্মহত্যায় তোলপাড়, বিক্ষোভ

নীতিমালা করার নির্দেশ ♦ অধ্যক্ষ বরখাস্ত মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভিকারুননিসা ছাত্রীর আত্মহত্যায় তোলপাড়, বিক্ষোভ

অরিত্রী অধিকারী

অরিত্রী অধিকারী। অস্তমিত হওয়া এক সম্ভাবনার  নাম। তার কথা এলেই মনে পড়ে যায় হৃদয়বিদারক এক ঘটনার। ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির এই ছাত্রীর আত্মহত্যা কি শুধু একটি অপমৃত্যু? অরিত্রীকে নিয়ে এমন নানা প্রশ্নের ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সবার একটাই দাবি— ‘বিচার চাই, বিচার চাই’। কেউ কেউ বলছেন, ‘নৈতিক শিক্ষার দায় কি শুধুই অভিভাবকের? তবে স্কুল কেন?’ শুধু ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবক নয়, বাইরের অসংখ্য মানুষের মনে ঘুরেফিরে এই প্রশ্নগুলো আসছে। এ ঘটনায় ভীত স্কুলটির প্রায় সব অভিভাবক। পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোনে নকলের কারণে ছাড়পত্র ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে সৃষ্টি হয়েছে তোলপাড়।

গতকাল অরিত্রীর আত্মহত্যার প্রতিবাদে এবং দায়ীদের শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে তার সহপাঠীরা। পাশাপাশি ঘটনাটি নিয়ে পৃথক আদেশও দিয়েছে হাই কোর্টের দুটি বেঞ্চ। এ দিন অভিভাবকরাও ছিলেন সরব। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে অভিযুক্ত শিক্ষক জিন্নাত আরাকে। উত্তপ্ত এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভিকারুননিসা নূন স্কুলে উপস্থিত হয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। বের হয়ে গাড়িতে উঠলে ছাত্রীদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। পরে বাইরে এসে ছাত্রীদের আশ্বস্ত করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা ভিকারুননিসায় জড়ো হতে থাকেন। অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের অপসারণের দাবি জানান তারা। এ সময় তাদের হাতে বিভিন্ন প্লাকার্ড দেখা যায়। এতে লেখা ছিল, ‘এ কেমন শিক্ষক, যার জন্য শিক্ষার্থীকে জীবন দিতে হয়!’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’সহ বিভিন্ন স্লোগান। বিক্ষুব্ধ অভিভাবকরা বলেন, ‘এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। অভিভাবকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি। আমরা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাই। এর দায়ভার কেন অভিভাবকদের?’ ভর্তিবাণিজ্য, শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগও আনেন তারা।

হাই কোর্টের দুটি বেঞ্চের পৃথক আদেশ : গতকাল বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ ১৫ বছরের ওই ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনাকে হৃদয়বিদারক ও বাজে রকমের দৃষ্টান্ত বলে মন্তব্য করেন। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। এদিকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরিতে অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্টের অপর একটি বেঞ্চ। হাই কোর্টের এই বেঞ্চের স্বতঃপ্রণোদিত আদেশটিতে (সুয়োমোটো রুল) ওই ছাত্রীর আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করে গঠিত কমিটিকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। একই সঙ্গে পাঁচ সদস্যের কমিটিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের নিচে নয় এমন একজন প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, মনোবিদ ও আইনবিদ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দুই তদন্ত কমিটি : ছাত্রীর আত্মহত্যার কারণ খতিয়ে দেখতে মাউশি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির পক্ষ থেকে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক মো. ইউসুফকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। কমিটির অন্যরা হলেন মাউশির ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপপরিচালক শাখাওয়াত হোসেন ও ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ। এ ছাড়া ভিকারুননিসা স্কুলের গভর্নিং বডির পক্ষ থেকে আরেকটি তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটিতে গভর্নিং বডির সদস্য আতাউর রহমান ও তিন্না খুরশীদ জাহান এবং শিক্ষক ফেরদৌসী বেগমকে রাখা হয়েছে।

ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস শিক্ষামন্ত্রীর : ছাত্রী আত্মহত্যার ঘটনায় সমবেদনা জানাতে ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আসেন। ছাত্রীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষক মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করতে পারবেন না। ছাত্রীটি এতটাই নির্যাতনের শিকার যে সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। এরপর তিনি স্কুল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে গেলে বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা মন্ত্রীর গাড়ি অবরোধ করে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। প্রায় ২০ মিনিট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে ঘটনার বিচারের আশ্বাস দিয়ে পরিবেশ শান্ত হলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তিনি।

শোকাতুর পরিবেশ অরিত্রীর বাসভবনে : শান্তিনগরের ২৩/২৪ ঠিকানার ‘শান্তি নিবাস’ অরিত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখা যায় এক শোকাতুর পরিবেশ। পাঠ্যবইগুলো পড়ে আছে। জামা-কাপড়সহ অন্য জিনিসপত্রও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিছানায়। জানা গেল, হৃদরোগে আক্রান্ত বাবা দিলীপ অধিকারী ও মা বিউটি অধিকারী চিকিৎসা নিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছেন। বিউটি অধিকারীকে হার্টে রিং নিয়ে চলতে হচ্ছে। মেয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে যেন আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। অরিত্রীর চাচা নির্মল সেন এই প্রতিবেদককে বলেন, বাবা-মায়ের অনেক আদরের ছিল সে। পরীক্ষা শেষ করেই মালয়েশিয়া বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল তার। সে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে মানুষের সেবা করতে চেয়েছিল। কিন্তু শিক্ষকদের অমানবিক মানসিক নির্যাতনে তার সে আশা অপূর্ণই থেকে গেল। বড় বোনের আত্মহত্যার ঘটনায় যেন কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে ছোট বোন ঐন্দ্রীলা অধিকারীর।

পোষা বিড়ালকে খাইয়ে দরজা বন্ধ করে অরিত্রী : সোমবার দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পর পোষা বিড়ালকে খাইয়ে কক্ষের দরজা আটকিয়ে দেয় অরিত্রী। ডাকাডাকি করে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বাবা-মা বাসার কেয়ারটেকার সুবদেব চন্দ্র হালদারকে ডাকেন। পরে সুবদেব বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে ঢুকে অরিত্রীকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলতে দেখেন।

অভিযুক্ত শিক্ষককে অব্যাহতি : অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবির মুখে স্কুলটির প্রভাতী শাখার অভিযুক্ত শিক্ষক জিন্নাত আরাকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না— এ মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিসও দেওয়া হয়েছে।

 

ভিকারুননিসায় পরীক্ষা চলবে : অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় উত্তপ্ত পরিস্থিতিতেও চলমান চূড়ান্ত পরীক্ষা বন্ধ থাকবে না বলে জানিয়েছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। পরীক্ষা নির্বাচনের আগে শেষ করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। তাই কিছু শিক্ষার্থী দাবি জানালেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরীক্ষা স্থগিত বা পেছানো হবে না। পরীক্ষা যথারীতি চলবে। তিনি বলেন, কেউ চলমান পরীক্ষায় না বসলে গভর্নিং বডির সভা করে পরে তাদের পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে।

প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় : ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অরিত্রীকে নিয়ে দেওয়া পোস্টগুলো হলো— ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ পাহাড়সম ভারী। দিলীপ অধিকারীর বেদনা হয়তো আমরা কেউ ছুঁতে পারব না। সোমবার চোখের পলকে তিনি মেয়েকে হারালেন। কিন্তু অরিত্রীর আত্মহত্যা কি একটি অপমৃত্যু?’, ‘বাবার চোখের জলের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছে মেধাবী ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী! অস্তমিত হলো একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ! হয়তো সে হতে পারত মহাকাশ গবেষক অথবা প্রযুক্তিবিদ, কিন্তু গল্পটার এখানেই সমাধি হলো! কে নেবে এই অসময়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভার...?’, ‘অরিত্রী হয়তো বাবার এই কান্না-অপমান মেনে নিতে পারেনি। এরপর বাসায় গিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ওই স্কুলের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারবেন...? আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে এই অধ্যক্ষকে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হোক।’ ফেসবুক ছাড়াও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অরিত্রীর আত্মহত্যায় স্কুল কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্ত করে পোস্ট দেন অনেকে।

অধ্যক্ষসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা : ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে অধ্যক্ষ-শিক্ষকসহ তিনজনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তারা হলেন কলেজের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, শাখাপ্রধান জিনাত আখতার ও শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনা। রাজধানীর পল্টন থানায় অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে গতকাল এ মামলা করেন। পল্টন থানার উপপরিদর্শক সুজন তালুকদার বলেন, রাত ৮টার পর মামলাটি হয়েছে। শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, শাখাপ্রধান জিনাত আখতার ও শ্রেণিশিক্ষক হাসনা হেনাকে আসামি করা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর