রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোটে থাকছেন না খালেদা, তিন আসনেই বাতিল

ফিরলেন আব্বাস, আফরোজা মোর্শেদ খান

নিজস্ব প্রতিবেদক

তিন নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়নপত্র বাতিল করে দিলে তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে তিনটি আপিল করেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সেই আপিল নামঞ্জুর করেছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার আপিল নামঞ্জুর করা হয়। ইসির এই সিদ্ধান্তের ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকল না কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসনের। অবশ্য ইসির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পথ খোলা রয়েছে খালেদা জিয়ার। কিন্তু উচ্চ আদালতের আদেশে দুই বছরের বেশি দণ্ডপ্রাপ্তদের নির্বাচন করার পথ আগেই বন্ধ রয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যায় নির্বাচন ভবনে খালেদা জিয়ার আবেদনের শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়। খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা বাতিলের পক্ষে রায় দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং অপর তিন কমিশনার। আর প্রার্থিতা ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ভোট দেন। পরে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানান, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল আবেদনটি ৪-১ ভোটে নামঞ্জুর করা হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের জন্য খালেদা জিয়ার পক্ষে ফেনী-১ এবং বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু গত ২ ডিসেম্বর বাছাইয়ের সময় দণ্ডের কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করে দেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার পরে খালেদা জিয়ার আপিল শুনানি করা হয়। এরপর তা বিকাল পর্যন্ত স্থগিত রেখে মধ্যাহ্ন বিরতিতে যায় কমিশন। পরে বেলা ৩টার দিকে শুনানি শুরুর কথা ছিল ইসির। কিন্তু সিইসির কক্ষে চার নির্বাচন কমিশনার ফের বসেন। তাদের এ বৈঠক শেষে সাড়ে ৩টার পরই আপিলের মুলতবি শুনানি শুরু হয়। নির্বাচন ভবনের ১১ তলার আপিল শুনানি কক্ষে এ সময় খালেদার প্রধান কৌঁসুলি এ জে মোহাম্মদ আলীসহ অন্তত একডজন আইনজীবী ছিলেন। চট্টগ্রাম-৪ আসনে বিএনপির আসলাম চৌধুরীর আপিল আবেদন মঞ্জুর করে তার প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণার পর খালেদার শুনানি ফের শুরু হয় সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে। মোহাম্মদ আলী যুক্তি উপস্থাপনের একপর্যায়ে বলেন, ‘আমি ক্লিয়ার করার আগেই আপনি (সিইসি) অর্ডার দেন কেন? আমাকে একটু বলতে দেন। আপিল বিভাগের জাজমেন্ট শুনবেন না? আমি না বলার আগে জাজমেন্ট শেষ করে দিচ্ছেন কেন?’ তখন উপস্থিতিদের পক্ষ থেকে আপিল আবেদনের আদেশ ঘোষণার তাড়া দিতে শোনা যায়। এ পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মঞ্চের সামনে থাকা মাইক কাছে টেনে নিয়ে বলতে শুরু করেন আপিলের আদেশ। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘এটা আমার রায়।’ এরপর তিনি বলেন, ‘আইনগত বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়ার আপিল আবেদন মঞ্জুর করার পক্ষে আমি রায় প্রদান করিলাম।’ তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির আইনজীবীরা হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে করতে পুরো রায় না শুনেই বেরিয়ে আসেন। তারা বলতে থাকেন— ‘আমরা রায় পেয়ে গেছি, রায় মঞ্জুর করেছে কমিশন, ম্যাডাম নির্বাচন করতে পারবেন’। তখন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এটি ফুল কমিশনের রায় নয়, একজন কমিশনারের রায়...।’ ততক্ষণে বিএনপির আইনজীবীরা এজলাস কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনসহ আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের অনেকে ছিলেন সেখানে। পক্ষ-বিপক্ষে উঁচু স্বরের কথাবার্তায় হট্টগোলের রূপ নেয়।

কমিশন পুরোপুরি শান্ত হলে অন্য নির্বাচন কমিশনারদের আদেশ পড়ে শোনানো হয়। সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোনয়নপত্র বাতিলে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত বহাল রাখার পক্ষে মত দেন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। আদেশে তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ও খালেদা জিয়ার দণ্ড বহাল থাকায় আপিল আবেদন আমি নামঞ্জুর করলাম।’ এরপরই নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীও ‘আপিল আবেদন নামঞ্জুর করলাম’ বলে ঘোষণা দেন। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ‘দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে আমরা তার (খালেদা জিয়ার) আপিল আবেদনটা নামঞ্জুর করছি।’ সবশেষে সিইসি নূরুল হুদা একীভূত আদেশ তুলে ধরার পাশাপাশি নিজের অবস্থান জানান এভাবে— ‘তিনজন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরী যে বক্তব্য দিয়েছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে দণ্ড বহাল রয়েছে, সে কারণে আমিও এ আপিল নামঞ্জুর করে দিলাম।’ পাঁচ সদস্যের কমিশনের পুরো আদেশ এরপর ইসি সচিব হেলালুদ্দীন পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনজন নির্বাচন কমিশনার এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চারজন আপিল আবেদন নামঞ্জুর করেছেন; সেহেতু খালেদা জিয়ার আপিল আবেদন নামঞ্জুর করা হলো। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে ৪:১ এর ভিত্তিতে (চারজন নামঞ্জুর, একজন মঞ্জুর) আপিল নামঞ্জুর হলো।’ এ সময় হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবউদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেন, বেগম জিয়ার মনোনয়নপত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। মাহবুব তালুকদারের সিদ্ধান্ত ‘ফেয়ার’ ছিল বলে দাবি করেন তিনি।

প্রার্থিতা ফিরে পেলেন মোরশেদ খান : রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। তিনি চট্টগ্রাম-৮ আসনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দাখিল না করায় এবং বিদ্যুতের বিল খেলাপি হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। গতকাল শুনানি শেষে সিইসি কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন আপিল কর্তৃপক্ষ মোরশেদ খানের আবেদন মঞ্জুর করে।

টিকে রইলেন আব্বাস-আফরোজা : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের মনোনয়নপত্রও বৈধ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের আপিল শুনানি শেষে এ সিদ্ধান্ত আসে। ঢাকা-৮ আসনে বিএনপির মির্জা আব্বাসের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা হয় বাছাইয়ে। রিটার্নিং কর্মকর্তার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একই আসনে ১৪ দলের প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন আপিল করেন। আপিল শুনানিতে মেননের আইনজীবী আব্বাসের মনোনয়নপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলেও তা নামঞ্জুর করে ইসি। এর মাধ্যমে আব্বাসের মনোনয়নপত্র থাকল। এদিকে মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসও ফিরলেন প্রার্থিতা নিয়ে। টেলিফোন বিল বকেয়া ও ঋণ খেলাপি হওয়ায় ঢাকা-৯ আসনে ধানের শীষের টিকিট পাওয়া মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর