মঙ্গলবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জর্জ হ্যারিসনের গানে বিশ্ব চিনেছিল বাংলাদেশকে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

জর্জ হ্যারিসনের গানে বিশ্ব চিনেছিল বাংলাদেশকে

বিজয়ের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো বিদেশি বন্ধু জর্জ হ্যারিসনকে। যার গানের টানে বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের ওপর চলা পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বর্বর চিত্র। সময়টা তখন ১৯৭১। যুদ্ধের বিভীষিকায় রক্তাক্ত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার ফলে প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে ত্রাণসামগ্রীর অপ্রতুলতা দেখা দেয়। শরণার্থী জীবন এমনিতে দুর্বিষহ। এ পরিস্থিতিতে চুপ করে বসে থাকতে পারেননি বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তিনি কথা বললেন জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। রবিশঙ্কর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হ্যারিসনকে যুক্তরাষ্ট্রে দাতব্য সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজনের কথা বললেন। হ্যারিসন অকুণ্ঠ চিত্তে বন্ধুর প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তার বন্ধুদের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। জর্জ হ্যারিসন কীভাবে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন তার নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আই মি মাইন’ এ। মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে কনসার্টের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। হ্যারিসন সবার আগে তার পূর্বেকার দল বিটলসের সদস্যদের কনসার্টে যোগ দিতে বলেন। নানা জটিলতায় অবশেষে বিটলসের একমাত্র রিঙ্গোস্টার যোগ দিতে সক্ষম হন। সঙ্গে আরও যোগ দেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন ও বিলি প্রেস্টন। বিটলস ভেঙে যাওয়ার পর জর্জ হ্যারিসন প্রথমবারের মতো পারফর্ম করেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের আগস্টের প্রথম দিবসে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের ৪০ হাজার আসনের মধ্যে একটিও খালি ছিল না। দর্শকদের এই অভূতপূর্ব সাড়ায় শিল্পীরাও উজ্জীবিত হন। জর্জ হ্যারিসন ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে রবিশঙ্করের কাছে সেতারবাদন শিখতে শুরু করেন। একই সঙ্গে যোগসাধনা করেছেন। ভারতে এসেছেন কয়েকবার। তিনি ভারতীয় দর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে এসে জর্জ বুঝতে পারেন যে, তার পক্ষে ভালো সেতারবাদক হওয়া সম্ভব নয়। তবে তাদের মধ্যকার গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব শেষ জীবন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য করতে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এ ধরনের বড় একটি অনুষ্ঠান বিশ্বে প্রথমবারের মতো হয়েছিল। এতে জর্জ হ্যারিসন তৃপ্ত হয়েছিলেন। রবিশঙ্কর আনন্দিত হয়েছিলেন। আফ্রিকার ক্ষুধার্তদের জন্য বা অন্য কোনো বিষয়ে তারপর বিশ্বের নানা দেশে নানা বিষয়ে বড় বড় কনসার্ট হয়েছে। বিশ্বের নামিদামি শিল্পীরা তাতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর যে ব্যাপক প্রভাব, সেটা অন্য কোনোটির ক্ষেত্রে হয়নি। আই মি মাইন বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, ‘মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু সংবাদপত্রে শুধু কয়েক লাইন, ‘ও, হ্যাঁ, এখনো এটা চলছে।’ আমরা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। এখনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যারা বলেন, ‘ওহ, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু।’ বিকাল থেকে অনেক রাত অবধি কনসার্টটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম পর্বে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও তার দলের পরিবেশনা এবং শেষ পর্বে হ্যারিসন ও অন্যরা। সেতারে রবিশঙ্কর, সরোদে ওস্তাদ আলী আকবর খানের সুরে যন্ত্রসংগীতের মাধ্যমে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সূচনা ঘটে। তাদের তবলায় সঙ্গত করেন ওস্তাদ আল্লা রাখা খান, তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। এর একটি ছিল বব ডিলানের সঙ্গে। বব ডিলান গেয়েছিলেন পাঁচটি গান। রিঙ্গোস্টার ও বিলি প্রেস্টন একটি করে গান করেছিলেন। লিওন রাসেল একটি একক এবং ডন প্রেস্টনের সঙ্গে একটি গান করেছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। গানটি লিখেছেন জর্জ হ্যারিসন এবং সুরও তার। গানের মূল কথাই ছিল বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান। গানের কথায় এমন আবেদন ছিল যে ‘সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই/ কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই’। জর্জ হ্যারিসন পুরো গানটা গেয়েছেন উচ্চৈঃস্বরে করুণ বিলাপের সুরে গভীর মানবিক আবেদন নিয়ে। সে জন্য গানের সেই সুর আজও আমাদের উজ্জীবিত করে। এই কনসার্ট থেকে সংগৃহীত ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য দেওয়া হয়েছিল। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মাধ্যমে বিশ্ববাসী আরও ভালোভাবে জেনেছিল, সভ্যতার ভয়াবহ গণহত্যা ও ধ্বংসের মাঝে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। সেই থেকে বাংলাদেশের জনগণের কাছের মানুষ জর্জ হ্যারিসন।

সর্বশেষ খবর