বুধবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু পণ্ডিত রবিশঙ্কর

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু পণ্ডিত রবিশঙ্কর

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে সারা দেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধযুদ্ধ। নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয় বিশ্ববিবেক। যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের অসহায়ত্ব তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন ভারতের জগদ্বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়ানো নিরীহ মানুষের আহাজারিতে সাড়া দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু রবিশঙ্কর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যার সূত্রপাত করে। তাদের খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে দেশ পরিণত হয় নরকে। সীমান্তের ওপারে ভারতে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের ভয়ানক নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের খবর আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। স্বীকৃতি আর সহযোগিতার আশায় বাংলাদেশ তখন তাকিয়ে আছে অন্যান্য রাষ্ট্রের দিকে। পণ্ডিত রবিশঙ্কর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তার শিষ্য-বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এক অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন; যার নাম ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হয়; যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে আছে। ’৭০-এর উত্তাল দিনগুলোয় রবির যন্ত্রণার সঙ্গী হয়ে কনসার্টের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন জর্জ। জর্জ ও রবি বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য তাদের আরও কিছু করার ছিল। কনসার্টটির কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আর গণহত্যা তাদের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। এ প্রসঙ্গে জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বলেছিলেন, ‘জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবিশঙ্করকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিলেন তিনি। অন্যদিকে নিজের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন জর্জ। এ সময় রবিশঙ্কর জানান, বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চান। এ উদ্যোগে তিনি জর্জকে পাশে চান। জর্জেরও মনে হলো, এ কাজে তার যুক্ত হওয়া উচিত। তার ডাকে অনেকে সাড়া দেবে, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে ওই কনসার্ট আয়োজন সময়োপযোগী ছিল। জর্জ তখন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাখা খান ও রবিশঙ্করকে নিয়ে আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।

কনসার্টটির শুরুতেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘প্রথম ভাগে ভারতীয় সংগীত থাকবে। এর জন্য কিছু মনোনিবেশ দরকার। পরে আপনারা প্রিয় শিল্পীদের গান শুনবেন। আমাদের বাঁধন শুধুই সুর নয়, এতে বাণী আছে। আমরা শিল্পী, রাজনীতিক নই। বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশের পল্লীগীতির সুরের ভিত্তিতে আমরা বাজাব “বাংলা ধুন”। যাকে বাংলাদেশের লোকসংগীতের এক অনন্য সুর বলা হয়।’ তিনিই ‘বাংলা ধুন’ নামের একটি নতুন সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে কনসার্ট শুরু হয়েছিল। তারা মাত্র ৯০ সেকেন্ডের ধুন বাজান। দর্শক-শ্রোতারা মনে করেছিল তারা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি ধুন শুনে ফেলেছেন। কিন্তু দর্শকদের ভুল ভেঙে দেন স্বয়ং রবিশঙ্কর। তিনি বললেন, আপনাদের বাদ্যযন্ত্র টিউন করাটা যদি এত ভালো লাগে, তাহলে আসল ধুনটি আরও ভালো লাগবে। সেতারে রবিশঙ্কর, সরোদে ওস্তাদ আলী আকবর খান। তাদের তবলায় সঙ্গত করেন ওস্তাদ আল্লা রাখা খান, তানপুরায় ছিলেন কমলা চক্রবর্তী। এরপর হ্যারিসনসহ বেশ কয়েকজন শিল্পীর পরিবেশনায় শেষ হয় আয়োজন। এ কনসার্টের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী জেনেছিল বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার কথা। বিজয়ের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বাংলাদেশের সেই অকৃত্রিম বন্ধুকে।

 

সর্বশেষ খবর