বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইসিতে দুই দলের পাল্টাপাল্টি

কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ আওয়ামী লীগের, বিএনপির বক্তব্য পুলিশের বিরুদ্ধে, ফখরুলের ওপর হামলা নিয়ে বিব্রত সিইসি, ২৪ ডিসেম্বর থেকে সেনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইসিতে দুই দলের পাল্টাপাল্টি

‘উৎসবের আমেজে’ একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় নির্বাচন কমিশনের কাছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ বলেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার যে ঘটনা ঘটছে, সেগুলো আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি হচ্ছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, বেছে বেছে তাদের ওপরই এই আক্রমণ করা হচ্ছে। এদিকে বিএনপি বলছে, সারা দেশে তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। পুলিশ এসব হামলা ঠেকানো বা সে সব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে উল্টো তাদের গ্রেফতার-হয়রানি করছে। এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, এটা কখনো কাম্য হতে পারে না। আমরা বিব্রত।

সবমিলে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে এই বৈঠক হবে।

বিব্রত সিইসি : একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর দ্বিতীয় দিনেই সহিংসতায় প্রাণক্ষয়ের ঘটনায় নিজের মর্মবেদনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। তিনি বলেছেন, আমরা মঙ্গলবার অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলেছিলাম, নির্বাচন কার্যক্রমে কোনো অঘটন ঘটেনি। কিন্তু মঙ্গলবারে যে ঘটনা ঘটেছে, যেটা আমাদের বিব্রত করেছে, মর্মাহত করেছে। নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল ঢাকায় নির্বাচন ভবনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে এক ব্রিফিংয়ে সিইসি নূরুল হুদা এ মন্তব্য করেন। সিইসি বলেন, নোয়াখালীতে একজন যুবক নিহত হয়েছে, যেটি আমাদের অত্যন্ত বিব্রত করেছে, আমাদের ব্যথা দিয়েছে। আর ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিবের গাড়িবহরে হামলাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করে নূরুল হুদা বলেন, এটা কখনো কাম্য হতে পারে না। আমরা বিব্রত।

সহিংসতায় ‘বিব্রত ও ব্যথিত’ হওয়ার কথা বললেও নোয়াখালী ও ফরিদপুরে হতাহতের ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা সিইসির বক্তব্যে আসেনি। বরং তিনি সহিংসতার পথ থেকে বেরিয়ে আসতে সবাইকে পথ খুঁজে বের করার তাগিদ দেন। রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী, প্রার্থী, সমর্থক সবাইকে ধৈর্য ধরতে, নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে অনুরোধ করেন। নির্বাচনের বাকি দিনগুলোতে আর কোনো ‘অঘটন’ যেন না ঘটে, সেই প্রত্যাশার কথাও বলেন। তিনি বলেন, কারও নির্বাচনী প্রচারে কেউ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবেন না। যে কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি পরিহার করবেন, নিজেরাই সমাধান করবেন। ভোটের মাঠের প্রতিযোগিতা যেন প্রতিহিংসার রূপ না নেয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্র তৈরি যেন না হয় সে দায়িত্ব আপনারা পালন করবেন। এবার ১৮০০ প্রার্থীর ভোটের মাঠে প্রতিযোগিতায় থাকার বিষয়টি তুলে ধরে সিইসি বিচারিক হাকিমদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের বিচারিক মনমানসিকতা এ নির্বাচনকে আরও বেশি স্থিতিশীল করবে। সে হিসেবেই আপনারা কাজ করবেন। নিরপেক্ষভাবে সবার সঙ্গে একই আচরণ করবেন।

নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম এবং শাহাদাত হোসেন চৌধুরী এবং ইটিআই মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।

কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ আওয়ামী লীগের : প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম বলেছেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতার যে ঘটনা ঘটছে, সেগুলো আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি হচ্ছে। আপনারা নিশ্চয় জানেন যে, এরই মধ্যে আমাদের দুজন সদস্য নিহত হয়েছেন। তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তৃণমূলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কাজেই বেছে বেছে তাদের ওপরই এই আক্রমণ করা হচ্ছে। এটা আমরা নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করেছি। 

গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। এইচ টি ইমাম বলেন, ফখরুল ইসলামের গাড়িবহরে হামলার বিষয়ে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তারা তো পুলিশকে খবর দিয়ে সেখানে যায়নি। পুলিশেরও জানা ছিল না। স্থানীয়ভাবে ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, গুলশান অফিসে মনোনয়ন বাণিজ্য নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মির্জা ফখরুল ইসলামের ওখানেও। ওখানে তাদের দলের লোকেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে। আওয়ামী লীগের কেউ ছিল না। অথচ বিশেষ একটি পত্রিকায় এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাত্ক্ষণিকভাবে আমি ওই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। এ রকম ভুল হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এই সময়ে নানা রকম সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য মিডিয়ার কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে এ ধরনের বিষয় যাতে যাচাই-বাছাই করে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়। এমনভাবে পরিবেশন করে যাতে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে যোগ করেন।

চার পর্যবেক্ষক সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ : সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনে থাকা চারটি দেশীয় সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব না দেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। গতকাল সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ আবেদন জানায় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমাম। সিইসির সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশনে ১১৮টি নিবন্ধিত নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা রয়েছে, এদের মধ্যে চারটি সংস্থা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে প্রভাবিত করতে পারে। এরা হলো ডেমোক্রেসি ওয়াচ, যার প্রধান হচ্ছে শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান। খান ফাউন্ডেশন ড. আবদুল মঈন খানের স্ত্রীর। বগুড়ার লাইট হাউজ তারেক রহমানের।

বিএনপি ভাষ্য ইসি অসহায় : নির্বাচনী প্রচারের শুরুতে সহিংসতায় প্রাণহানিতে ‘ব্যথিত-বিব্রত’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে ‘অসহায়’ মনে করছে বিএনপি। গতকাল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে দেখা করার পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান জানান, সারা দেশে তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। পুলিশ এসব হামলা ঠেকানো বা সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে উল্টো তাদের গ্রেফতার-হয়রানি করছে। এসব বিষয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জানালে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে আশ্বাস দিতে পারেননি জানিয়ে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘আমরা মনে করি, তিনি অসহায়। তিনি বিব্রত বোধ করছেন, কারণ তিনি কিছু করতে পারছেন না।’

বৈঠক শেষে সেলিমা রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে আর কোনো নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হবে না বলে জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তারপরও আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। অজ্ঞাতনামা মামলার নামে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা সিইসিকে জানালে তিনি জানান, পুলিশের সঙ্গে এ বিষয়ে তারা কথা বলেছেন। পুলিশ বলেছে, তাদের নামে মামলা আছে। কমিশন এ বিষয়ে চেষ্টা করছে এবং করবেন বলে জানান তিনি। তবে সিইসির কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের আশ্বাস না মেলায় নির্বাচনে নিজেদের এজেন্ট খুঁজে পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান। প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বিজন কান্তি রায়।

২৪ ডিসেম্বর মাঠে নামছে সেনাবাহিনী : জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগামী ২৪ থেকে ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোনো সময় মাঠে নামবে সেনাবাহিনী।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, এর আগে তারা ১৫ ডিসেম্বর থেকে পরিস্থিতি অবলোকন (রেকি) করবে। সেনাবাহিনীর প্রতিটি টিমের সঙ্গে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হবে। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর