বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

যুদ্ধদিনের বন্ধু সায়মন ড্রিং

জয়শ্রী ভাদুড়ী

যুদ্ধদিনের বন্ধু সায়মন ড্রিং

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শুরু করে টালবাহানা। এ টানাপড়েনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্তের দিকে যাচ্ছে— এটা বুঝতে পারছিল বিশ্ব মিডিয়া। লন্ডনভিত্তিক ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর রিপোর্টার সাইমন ড্রিং তখন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে কাজ করছেন। লন্ডনের সদর দফতর থেকে ফোন করে তাকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’ সাইমন অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছিলেন লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম অঞ্চলে। পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। তবু তিনি মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় এলেন। পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের সময় লাখো মানুষের ঢলে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। মঞ্চের খুব কাছে দাঁড়িয়ে তিনি পুরো ভাষণ শুনলেন। বাংলা ভাষা না বুঝলেও শব্দের শক্তি আর দৃপ্ত অভিব্যক্তি তার চোখ এড়াল না। তিনি বুঝতে পারলেন পাকিস্তানিদের শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ আওয়াজ তুলেছে। মানুষ ‘জয় বাংলা’ চায়। সংকল্প ও আশায় উদ্দীপিত চোখে তারা চেয়ে আছে শেখ মুজিবের দিকে।

সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকা এসে সাইমন ড্রিং ফিরে যাওয়ার কথা আর ভাবতেই পারলেন না। পাকিস্তানের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও সব ঘটনা নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে লাগলেন লন্ডনে। এভাবেই পার হয়ে যায় দুই সপ্তাহ। এসে যায় ২৫ মার্চ। তিনি জানতে পারেন পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতা ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করছেন। আগের অভিজ্ঞতা থেকে সাইমন ধারণা করেন ঢাকায় ভয়ঙ্কর কিছু হতে যাচ্ছে। সাইমন উঠেছিলেন ঢাকার শাহবাগে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। বিদেশি সাংবাদিকরা তখন ঢাকার একমাত্র পাঁচতারকা এ হোটেলই উঠতেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলে। সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের হোটেলের ভিতরেই থাকতে হবে। অবরুদ্ধ বিদেশি সাংবাদিকরা সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান, কেউ কেউ জানালা দিয়ে দেখতে পান আগুন। কাছাকাছি কোথাও থেকে ভেসে আসছে মানুষের গোঙানির শব্দ। হোটেলে বসে দারুণ উৎকণ্ঠায় সময় পার করলেন সাংবাদিকরা। বিকাল ৫টায় সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালেক এসে হুকুমের সুরে বললেন, ‘তোমাদের এখনই ঢাকা ছাড়তে হবে।’ এরপর সাংবাদিকদের নিয়ে কয়েকটি ট্রাক সোজা বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেয়। সবাই চলে গেলেও দুজন সাংবাদিক সিদ্ধান্ত নেন তারা যাবেন না। বাঙালি বয়দের সহায়তায় তারা লুকিয়ে থাকেন হোটেলের কিচেনে। তাদের একজন দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার সাইমন ড্রিং এবং অন্যজন এপির অলোকচিত্রী মাইকেল লরেন্ট। রাতভর কিচেন ও বাথরুমে লুকিয়ে থাকেন তারা। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে এ দুই সাংবাদিক বেরিয়ে পড়েন শহরে।

প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (আগে নাম ছিল ইকবাল হক) যান সাইমন। সেখানে গিয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়ের মুখোমুখি হন তিনি। ছাত্রদের মৃতদেহ পুড়ছিল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে অনেক ছিন্নভিন্ন লাশ। আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে চিত্র ও তথ্য জোগাড় করতে থাকেন সাইমন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে গিয়ে দেখেন পাকিস্তানি সেনারা পতাকা উড়িয়ে রেখেছে এবং শত শত মৃতদেহ ট্রাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এক দিন পর ব্রিটিশ হাইকমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সাইমন। ঢাকা থেকে করাচি হয়ে ব্যাংকক যাওয়ার সময় পায়ের মোজার ভিতর নিয়ে যান নোটগুলো।

তারপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠাণ্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরের...।’ ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ তা ছাপা হয়। এ প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সঞ্চারের প্রাথমিক মুহূর্ত ছিল সেটি। তারপর সাইমন কলকাতায় আসেন নভেম্বরে। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফে। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।

১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা সিদ্দিক সালেকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সাইমনের। সাইমন তাকে জানান, ২৫ মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার সময় তিনি লুকিয়ে থেকে গিয়েছিলেন। এরপর প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমাকে খুঁজে পেলে তোমরা কী করতে?’ সিদ্দিক সালেক বলেছিলেন, ‘গুলি করে মারা হতো।’ এভাবে জীবন বাজি রেখে বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খবর বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন যুদ্ধদিনের বন্ধু সাইমন ড্রিং। তার এ প্রতিবেদন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার অমূল্য দলিল।

সর্বশেষ খবর