শনিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন আর নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন আর নেই

শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার ও সাহিত্যিক আমজাদ হোসেন। তিনি গতকাল বেলা ২টা ৫৭ মিনিটে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, চার ছেলে, এক মেয়েসহ আত্মীয়স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। গত ১৮ নভেম্বর ব্রেন স্ট্রোক করায় আমজাদ হোসেনকে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৭ নভেম্বর রাতে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৮ দিনের মাথায় গতকাল না ফেরার দেশে চলে গেলেন প্রখ্যাত এই শিল্পী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানিয়েছেন আন্তরিক সমবেদনা। ‘আমজাদ হোসেন নেই’ এই খবর তার বড় ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দোদুল নিশ্চিত করার পর দেশের চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র  নেমে আসে শোকের ছায়া। এফডিসি ও বিভিন্ন স্থানে তার ভক্ত-অনুরাগী ও সতীর্থরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ব্যাংকক থেকে মরদেহ কখন দেশে আনা হবে, এ বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি আমজাদ পরিবার।

আমজাদ হোসেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জামালপুরে। একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, গল্পকার, অভিনেতা, গীতিকার ও সাহিত্যিক হিসেবে সুখ্যাত তিনি।  কালজয়ী অনেক ছায়াছবির নির্মাতা তিনি। এর মধ্যে রয়েছে— নয়নমণি, ভাত দে, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, দুই পয়সার আলতা, জন্ম থেকে জ্বলছি ইত্যাদি। গোলাপী এখন ট্রেনে ও ভাত দে  ছবির জন্য আমজাদ হোসেনকে শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। শিল্পকলায় অবদানের জন্য তাকে ভূষিত করা হয় একুশে পদকে (১৯৯৩)। এ ছাড়া সাহিত্য রচনার জন্য তিনি ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে দুইবার অগ্রণী শিশু সাহিত্য পুরস্কার ও ২০০৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন।

ব্যতিক্রমধর্মী এই চলচ্চিত্র নির্মাতা তার কর্মজীবনে ১২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ৬টি বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে একসঙ্গে ছয়টি ভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন এবং একই সঙ্গে পাঁচটি বিভাগে (গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রের জন্য) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৬১ সালে ‘তোমার আমার’ ছবিতে আমজাদ হোসেনের অভিনয় জীবন শুরু। একই বছর মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে অভিনয় করেন। তার লেখা নাটক ‘ধারাপাত’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক সালাহ্?উদ্দিন। ছবিটি মুক্তি পায়। এতে তিনি প্রধান একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন। পরবর্তীকালে তিনি জহির রায়হানের সঙ্গে যোগ দেন এবং তার সহকারী হিসেবে কয়েকটি ছবিতে কাজ করেন। এর মধ্যে রয়েছে বেহুলা (১৯৬৬)। পরে তিনি চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনায় মনোনিবেশ করেন।  আমজাদ পরিচালিত প্রথম ছবি ‘আগুন নিয়ে খেলা’ (১৯৬৭)। পরে তিনি নয়নমণি (১৯৭৬), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), ভাত দে (১৯৮৪) নির্মাণ করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা অর্জন করেন। তার লেখা কাহিনী নিয়ে ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি জহির রায়হান পরিচালিত সাড়া জাগানো ‘জীবন থেকে নেয়া’। ১৯৮০-এর দশকে কসাই (১৯৮০), জন্ম থেকে জ্বলছি (১৯৮২), দুই পয়সার আলতা (১৯৮২), ভাত দে (১৯৮৪), কসাই (১৯৮২) সহ কয়েকটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দেন। চলচ্চিত্র ছাড়াও টিভি নাটক ‘জব্বর আলী’ নির্মাণ ও এতে অভিনয় করে ছোট পর্দার দর্শকদের কাছেও আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা লাভ করেন বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। আমজাদ হোসেনের দুই ছেলে সাজ্জাদ হোসেন দুদুল ও সোহেল আরমান। আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে চলচ্চিত্র প্রযোজক, প্রদর্শক, পরিচালক, শিল্পী সমিতি ও শিল্পী ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে গভীর শোক ও মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়েছে।

তার রচিত উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— নিরক্ষর স্বর্গে, ধ্রুপদী এখন ট্রেনে, দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভালোবাসা, আমি এবং কয়েকটি পোস্টার, রক্তের ডালপালা, ফুল বাতাসী, রাম রহিম, আগুনে অলঙ্কার, ঝরা ফুল, শেষ রজনী, মাধবী ও হিমানী, মাধবী সংবাদ ইত্যাদি। এ ছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস, জীবনী, ইতিহাস, কিশোর উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, ফিকশন, রচনাসমগ্র, কিশোরসমগ্র রচনা করে গেছেন।

সর্বশেষ খবর