শনিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুঃসময়ে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

দুঃসময়ে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যখন মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন আমি ৩৬ বছরের এক তরুণ সংসদ সদস্য। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে ভারতের সমর্থন দানের জন্য ১৯৭১ সালের ১৫ জুন ভারতের রাজ্যসভায় আমি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম।’ এভাবে প্রণব মুখার্জি তখন থেকেই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে ওঠেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৩ সালে প্রণব মুখার্জির হাতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। তখন তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি। সম্মাননা গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি ইতিহাসের পাতা উল্টে যেন ফিরে গিয়েছিলেন একাত্তরে। বাংলাদেশের মানুষের পরম আত্মীয় হওয়ার গল্প বলেছিলেন নিজেই।

তার আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ এ তিনি একটি পুরো অধ্যায়ই লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ : দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ নামে। বইয়ের এই অধ্যায়টি প্রণব শুরু করেছেন ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত ডমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। এরপর জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতে যখন এসব ঘটছিল, তখন পাকিস্তানের পূর্বাংশে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ ঘটনাই ১৯৭১ সালে উপমহাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাকিস্তানের জন্য বছরের শুরুটা ইতিবাচক হলেও বছরের শেষে দেশটি ভাগ হয়ে যায়। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল দুটি পৃথক ভৌগোলিক অংশের সমন্বয়ে, যার মাঝখানে ছিল ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নামে তারা দুটি দেশে পরিণত হয়।’

এরপর প্রণব মুখার্জি পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিমাদের শোষণ ও বঞ্চনা তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশে ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তারও নাতিদীর্ঘ বর্ণনা দেন। তার লেখায় আছে ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে কী প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। ৩০ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারতের লোকসভায় নেওয়া প্রস্তাবটি ছিল এ রকম : ‘পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে লোকসভা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সেখানে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ন্যায়সঙ্গতভাবে যে রায় দিয়েছে, সেই রায়ের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানোর বদলে পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছে। এই লোকসভা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও সংহতি প্রকাশ করছে এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি অবিলম্বে নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের ওপর বলপ্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে।’

প্রণব মুখার্জি তখনো ইন্দিরা গান্ধীর দলে যোগ দেননি। বাংলা কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রণব লিখেছেন, ‘১৫ জুন বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। একজন সদস্য জানতে চান, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। উত্তরে আমি জানাই, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।’

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রণব মুখার্জির রাজনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। তিনি লিখেছেন, ‘সে সময় থেকেই ইন্দিরা গান্ধী আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমাকে প্রথম আন্তঃ সংসদীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য মনোনীত করেন। সেই বৈঠকে আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা, যাতে তারা যে যার দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের সরকারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন। হতে পারে এই বৈঠকে আমার ভূমিকার কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি খুশি হয়েছিলেন। কেননা, এরপর একই দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠান।’ প্রণব মুখার্জি ১৯৭২ সালে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯৭৬ সালে ইন্দিরার মন্ত্রিসভার সদস্য হন। শুধু মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে জনমত গঠনেই নয়, তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল পরবর্তী সময়েও। ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন প্রণব মুখার্জি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রতিটি ইতিহাসে ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে তার। বাংলাদেশের সঙ্গে তার হার্দিক সম্পর্ক রয়েছে। তার স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি নড়াইলের মেয়ে। সেই সূত্রে তিনি বাংলাদেশের জামাই।

প্রণব মুখার্জি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের আরেক খণ্ড ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২’ বইতে লিখেছেন, কোন অবস্থায় জেনারেল মইনকে দিল্লিতে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি একটা শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দিকে জোর দিয়েছিলাম।’ তিনি আরও লিখেছেন, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ছয় দিনের ভারত সফরে যান। এ সময় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জেনারেল মইন। বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘তাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি এই ভয় পাচ্ছিলেন যে, শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাকে চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিই এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তার বহাল থাকার ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করি।’ এ ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে তার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সাক্ষাৎ চাই। তৎকালীন ভারতের জাতীয় উপদেষ্টা এম কে নারায়ণের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে আমি সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলাম।’ এভাবে স্বাধীনতা থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশের মানুষের পরমাত্মীয় এবং অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে উঠেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি।

সর্বশেষ খবর