রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
নাগরিক সংলাপে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ

অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির পরিপন্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, সুশাসনের ঘাটতি সত্ত্বেও দেশে দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণেই সুশাসনের সংকট প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। যার ফলে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। এটা মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির পরিপন্থী। গতকাল রাজধানীর এলজিইডি মিলনায়তনে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক নাগরিক সংলাপে এসব কথা বলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পিছিয়ে গেলে অর্থনৈতিক উন্নতিতে কোনো লাভ হবে না। এ জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন, যা নির্বাচিত সরকারকে  বৈধতা দেবে। এ ছাড়া আগামী নির্বাচনী আয়োজনে দুই ধরনের পরীক্ষা রয়েছে। তাছাড়া বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও তা মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। সেই সঙ্গে বাড়ছে ব্যাপক আয় বৈষম্যও। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো বিধিবিধান না থাকায় যে যার মতো দল গঠন করছেন। এতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানসম্মত শিক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। আমাদের সীমিত জমি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে হবে। অন্যথায় পুরো দেশটি আধা শহরে পরিণত হবে। এতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে পুরো দেশের। ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি ব্যবস্থা।

ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, নির্বাচন জনগণের চোখে অবশ্যই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রয়োজন। যা নির্বাচিত সরকারকে বৈধতা দেবে। দ্রুত প্রবৃদ্ধি অবধারিত নয়। সুশাসন ও উন্নয়নে সমীকরণের পরিবর্তন দরকার। কেননা মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়ছে। নতুন আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে। কম খরচে বেশি সুবিধা পাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে যা স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। শত বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। এটা স্বীকার করতেই হবে। ‘মিডল ইনকাম উইথ কোয়ালিটি অ্যান্ড ডিগনিটি : সিভিক ডায়ালগ এন এজেন্ডা ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই নাগরিক সংলাপ সঞ্চালনা করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান। প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, মেজর জেনারেল গোলাম কাদের (অব.), বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.), ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর এম এ তসলিম, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, ঢাকা চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান, অ্যাকশনএইডের বাংলাদেশ প্রধান ফারাহ কবীর, মেট্রোপলিটন চেম্বার্স ও কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি নাসিম মঞ্জুর, পাঠাও-এর চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার ফাহিম আহমেদ প্রমুখ। এ ছাড়া সূচনা বক্তব্য রাখেন আইসিসিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট রোকেয়া আফজাল রহমান। প্যানেল আলোচকের বাইরে আরও বক্তব্য রাখেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহিম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ প্রমুখ। ড. হোসেন জিলুর রহমান বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও মানসম্মত কর্মসংস্থানের প্রকট সংকট রয়েছে। এর জন্য গভীর সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, নির্বাচনী আয়োজনে দুই ধরনের পরীক্ষা রয়েছে। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জনগণের ভোটের পরীক্ষা। অন্যটি হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনার পরীক্ষা। এ দুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এ ছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক যে অবস্থা ‘বিজনেস এজয়ুজ্যুয়াল’ অবস্থায় চললে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে দিক পরিবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া নাগরিক সক্রিয়তার অন্যতম উপাদান বজায় রাখতে হবে। ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, অর্থমন্ত্রী কয়েক দিন আগে বললেন উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে বাংলাদেশ, এসব কথা বাতুলতা মাত্র। কেননা মহাসড়কে যেতে হলে একটি ফিটনেস সম্পন্ন গাড়ি, একজন দক্ষ চালক এবং কিছু নীতি ও রেগুলেশন দরকার।  যার কোনোটাই এখন বাংলাদেশে নেই। ফলে এসব কথা হলো বাতুলতা। আমাদের ড্রাইভার ঠিক করতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হবে। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সাধারণত প্রবৃদ্ধি বাড়লে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় নিছু নেই। বর্তমানে দশমিক ৪৮ শতাংশ আয়বৈষম্য বিপজ্জনক অবস্থানের কাছাকাছি আছে। অধ্যাপক এম এ তসলিম, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, শ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি বিষয়গুলোর মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি তুলে ধরে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আবুল কাশেম খান বলেন, ডুয়িং বিজনেসের খরচ অনেক বেশি। বিদ্যুৎ প্রাপ্তিতে সমস্যা, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। নাসিম মঞ্জুর বলেন, এখন আবার শুনছি ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো হবে। এটা ঠিক হবে না। জমির সমস্যা তো রয়েছেই। তাছাড়া কর ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। আবদুল মজিদ বলেন, সরকার রাষ্ট্রকে অধিগ্রহণ করে ফেলেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যে কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তা ছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হতে পারত। কিন্তু জিডিপির আড়াই থেকে তিন শতাংশ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে সইতে পারে না। এ অবস্থার অবসান হতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে এখন আর কেউ শিক্ষার্থী নেই, সবাই পরীক্ষার্থী। এই ব্যবস্থারও পরিবর্তন করতে হবে।

সর্বশেষ খবর