মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে

ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য, সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠাসহ ৩৫ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপিকে নিয়ে পাঁচ দলের গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে হোটেল পূর্বাণীতে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়।  ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন এই ইশতেহার ঘোষণা করেন। এতে বলা হয়, ক্ষমতায় গেলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ছাড়া চাকরিতে কোনো বয়সসীমা থাকবে না। ৩০ বছরের ওপর শিক্ষিত বেকারদের ভাতা দেওয়া হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখা হবে। বাতিল করা হবে ‘বিতর্কিত’ ডিজিটাল অ্যাক্ট। স্বাগত বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘এটা জনগণের ইশতেহার। জনগণের কল্যাণ, জনমতের ভিত্তিতে এটা তৈরি করা হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণের ধারা অব্যাহত থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, ভোটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে  দেশে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা হবে। বিগত ৫০ বছরে এমনটা দেখিনি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রত্যেক প্রার্থীর ওপর হামলা হচ্ছে। এই রাষ্ট্রের মেরামত প্রয়োজন। আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিন ৩০ ডিসেম্বর। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিশ্বাস করে, সেদিন দলে দলে, জনে জনে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে। ভোট দেবে, ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করে ভোটের অনিয়ম এবং ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষ হওয়ার পর নিজেদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া দেখে বাড়ি ফিরবে। নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে এক গণঅভ্যুত্থানের দিন হবে ৩০ ডিসেম্বর।’ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার পাঠ করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, ‘৩৫ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ও ১৪ দফা প্রতিশ্রুতি মিলে আমাদের এই ইশতেহার। এই নির্বাচনে জিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাষ্ট্রের সব নাগরিকের কল্যাণে সরকার পরিচালনা করবে। এই পরিচালনার মূলনীতি হবে ঐকমত্য, সরকারের অন্তর্ভুক্তি এবং যে কোনো রকম প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত রাখা।’ এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, ড. রেজা কিবরিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখযোগ্য ১৪টি প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে— 

১. কোনো প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা নয়, জাতীয় ঐক্যই লক্ষ্য : মিথ্যা মামলা, গুম, খুন ও মামলার ঘুষবাণিজ্য, বিচারবহির্ভূত হত্যায় লক্ষাধিক পরিবার ক্ষুব্ধ, বিপর্যস্ত। এ সমস্যা সমাধানে ‘সর্বদলীয় সত্যানুসন্ধান ও বিভেদ নিরসন কমিশন গঠন’ করা হবে।

২. নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা : এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে নারীর ওপর যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো হবে। মামলাজট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করা হবে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ করাসহ সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে গ্রেফতার না করা ও রিমান্ডে নিয়ে কাউকে নির্যাতন না করা। মিথ্যা মামলায় সহায়তাকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা  নেওয়া হবে। অভিযুক্তদের অভিযোগ প্রমাণ না হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ কর্মক্ষেত্রে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর ওপর বাচিক কিংবা শারীরিক যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হবে।

৩. ক্ষমতার ভারসাম্য : সংসদে একটি উচ্চকক্ষ সৃষ্টি ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। একটানা পর পর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।  একই সঙ্গে বাংলাদেশে প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা পরীক্ষার জন্য একটি সর্বদলীয় জাতীয় কমিশন গঠন করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

৪. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ : স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলা হয়, দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব থাকবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে। পৌর এলাকায় সিটি গভর্নমেন্ট চালু করার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয় এতে।

৫. দুর্নীতি দমন এবং সুশাসন : দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা গ্রেফতারে সরকারের অনুমতির বিধান (সরকারি চাকরি আইন-২০১৮) বাতিল করা হবে। এ ছাড়া অর্থ পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা হবে।

৬. কর্মসংস্থান ও শিক্ষা : পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য কোনো বয়সসীমা রাখা হবে না। সরকারি চাকরিতে কোটার ব্যাপারে বলা হয়, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রাখা হবে। এ ছাড়া আর কোনো কোটা থাকবে না। একই সঙ্গে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থার কথা জানিয়ে মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথাও উল্লেখ করা হয়।

৭. স্বাস্থ্য : তিন মাসের মধ্যে ওষুধ এবং ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এ ছাড়া ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এক বছর ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

৮. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন : সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এক বছরের মধ্যে মানুষকে ভেজাল ও রাসায়নিকমুক্ত নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কথাও বলা হয়।

৯. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি : নির্বাচিত হলে সরকারের প্রথম বছরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিসহ সর্বোচ্চ ১০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের বিদ্যুতের মূল্য আগামী পাঁচ বছরে বাড়াবে না ঐক্যফ্রন্ট।

১০. প্রবাসী কল্যাণ : প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া শ্রমশক্তি রপ্তানির জন্য নতুন নতুন বাজার খোঁজার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

১১. নিরাপদ সড়ক ও পরিবহন : নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। শহরে পরিবহন নীতি প্রণয়ন করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

১২. প্রতিরক্ষা ও পুলিশ : প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র কেনা হবে। পুলিশ সদস্যদের ঝুঁকিভাতা বাড়ানো এবং জাতিসংঘ বাহিনীতে পুলিশের অংশগ্রহণ বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে।

১৩. পররাষ্ট্রনীতি : ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। এ ছাড়া চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যেসব প্রকল্প দেশের জন্য লাভজনক, সেগুলো যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

১৪. জলবায়ু পরিবর্তন : জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন ও ক্ষতিকর প্রভাব রোধে আন্তর্জাতিক সাহায্য নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাসহ এর সদ্ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে।

সর্বশেষ খবর