শুক্রবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
সংসদ নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর এমপিদের শেখ হাসিনা

ক্ষমতাকে ব্যক্তিসম্পদ মনে করবেন না

রফিকুল ইসলাম রনি

ক্ষমতাকে ব্যক্তিসম্পদ মনে করবেন না

দলের নবনির্বাচিত এমপিদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত স্বার্থের হাতিয়ার কিংবা সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার বানাবেন না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। জনগণ যদি আমাদের সঙ্গে থাকে তবে কেউ রুখতে পারবে না। যেভাবে ঘরে ঘরে গেছেন ভোট চাইতে, সেভাবে এখন যান কৃতজ্ঞতা জানাতে। মনে রাখবেন, জনগণ সবই মনে রাখে। কে টাকা নিয়ে চাকরি দেয়, কে টিআর-কাবিখা দিতে টাকা নেয়, জনগণ কোনো কিছুই ভুলে যায় না। কাজেই জনগণের মন জয় করুন। তিনি গতকাল দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনে নবনির্বাচিত এমপিদের শপথ গ্রহণ শেষে দলের সংসদীয় দলের বৈঠকে বক্তৃতা করছিলেন। বৈঠকের শুরুতে শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতিতে সংসদ নেতা ও আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। বৈঠকের শুরুতেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। এ সময় সব এমপি সমস্বরে তাদের সম্মতি জানান। বৈঠক শেষে বেশ কিছু সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়। শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে  সরকারের অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করায় ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তাকে সংসদীয় নেতা করার এটাই যেন শেষ হয়। এ সময় সবাই সমস্বরে ‘নো নো, না না’ বলে ওঠেন। সংসদ সদস্যরা বলেন, আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন আপনিই আমাদের সংসদীয় দলের নেতা, দলের নেতা, বাংলাদেশের নেতা এবং আমাদের অভিভাবক আপনি। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ আজকে মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। দেশবাসী আওয়ামী লীগকে বারবার ক্ষমতায় এনেছে। অথচ ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর মানুষ আওয়ামী লীগের নাম মুখে আনেনি। আমাকে আপনারা দলের সভানেত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার পর দেশে ফিরে আসি। আমাকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন আমাকে দেশে আসতে দিতে চাননি। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশে ফিরে গ্রামগঞ্জে পায়ে হেঁটে, ট্টেনে ভ্রমণ করে দলকে সংগঠিত করি। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে আসি। প্রধানমন্ত্রী ১৯৭৫ সাল পরবর্তী তার প্রবাস জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, মাত্র ১৫ দিন আগে আমি স্বামীর কর্মস্থলে গিয়েছিলাম রেহানাকে নিয়ে। জানতাম না, ওটা হবে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা। তিনি বলেন, আমি জার্মানি গেলাম ওখান থেকে ভারত এলাম, সেখানে মিসেস গান্ধী আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। তখন আমাদের দল বলতে কিছুই ছিল না, তারপর আমি লন্ডন গিয়েছি, সেখান থেকে আস্তে আস্তে দল গোছাতে শুরু করি।

দলের এমপিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের কাছে আমাদের যে ঋণ, তা পরিশোধ করতে হবে। উন্নয়নের মাধ্যমেই সেই ঋণ পরিশোধ করা হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, ক্ষমতাকে কেউ নিজেদের সম্পদ মনে করবেন না। আমরা আজ আছি, কিন্তু ক্ষমতা কোনো ভাবেই চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতাকে কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করবেন না, সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার বানাবেন না। তিনি বলেন, জনগণ সব কিন্তু মনে রাখে। জনগণের জন্য কাজ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হবে। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখতে হবে। জনসম্পৃক্ততা থাকলে ভবিষ্যতে হারবেন না। তিনি বলেন, অর্থ সম্পদ কার জন্য রেখে যাবেন! অর্থ সম্পদ রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদেরকে শিক্ষা দিন, সেটা থাকবে। অর্থ সম্পদ আজ আছে তো কাল না-ও থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষা সারাজীবন থাকবে। নিজের সন্তানকে টাকা দিতে না পারার স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, লন্ডনে থাকাকালে টাকার অভাবে জয়ের সেমিস্টার ড্রপও করতে হয়েছিল, আবার টাকা জোগাড় করে সেমিস্টার শুরু করতে হয়েছে। আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে এমআইটিতে তার সেমিস্টারের টাকা দিতে পারি নাই, লজ্জায় সে-ই আমাকে কথাটা বলেনি, আমি জেনেও সাহস করে কাউকে বলতে পারি নাই। কারণ আমি ভেবেছি, আমি প্রধানমন্ত্রী কার কাছে থেকে টাকা চাইব! এই দিনগুলোও আমাদের গেছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সেই দিন আর নেই। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে চোখ মুছতে দেখা গেছে। নবনির্বাচিত এমপিদেরও কেউ কেউ এ সময় আপ্লুত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর শেখ হাসিনা বলেন, ছেলেমেয়েদের সম্পদ একটাই করে দিয়েছি, তা হলো শিক্ষা। আমার ছেলে ও মেয়ে এখনো বিদেশে চাকরি করে। আপনারা ক্ষমতাকে সম্পদ বানানোর হাতিয়ার বানাবেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে ভালোবাসে। জনগণ যদি সঙ্গে থাকে কেউ আমাদের রুখতে পারবে না। আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা জনগণের কাছে থাকবেন, জনগণের সুখে-দুঃখে পাশে থাকবেন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে সেটা অব্যাহত রাখব। বাংলাদেশের মাটিতে কোনো সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের স্থান হবে না। মাদক সমাজকে ভয়াবহভাবে ক্ষতি করছে। কাজেই যারা মাদকের সঙ্গে জড়িত তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের ভরাডুবি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের মনোনয়ন দিয়েছে। তারা মনোনয়নবাণিজ্য করেছে, নির্বাচন নয় যেন তাদের লক্ষ্যই ছিল মনোনয়নবাণিজ্য করা। জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের সমুচিত জবাব দিয়েছে। তিনি বলেন, বিদেশে পলাতক এক নেতা এই মনোনয়নবাণিজ্য করেছে। দুবাই অ্যাম্বাসিতেও তারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন এমন রেকর্ড রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গত ১০ বছরে আমরা উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করেছি। নির্বাচনের ফলাফলে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। এই অর্জন ধরে রাখতে হবে। এদেশের মানুষ অতীতে বিএনপির দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবারের নির্বাচনে রায় দিয়েছে।

উন্নয়নের গতি আরও বেগবান করা হবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ২১০০ সালকে টার্গেট করে আমরা এ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। তিনি বলেন, ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলব। ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবার্ষিকী পালিত হবে। তখন যারা থাকবেন তারা স্বাধীনতার শতবার্ষিকী পালন করবেন একটা উন্নত সমৃদ্ধ দেশে। ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, মনে রাখবেন ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। তারা প্রত্যেকের নামে মামলা করতে পারে। এসব মামলা মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের যে অর্জন, যে বিজয় সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিজয়।

এ সময় দলের নবীন এমপিদের পার্লামেন্টের প্রসিডিং জানতে লেখা-পড়া করার নির্দেশ দেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, পনেরো দিন পরে অধিবেশন বসবে, সবাই ভালো করে প্রস্তুতি নেবেন। সংসদ লাইব্রেরিতে যাবেন, সেখানে বসে লেখা-পড়া করবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর