শুক্রবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন আমাদের নায়ক

ইমদাদুল হক মিলন

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন আমাদের নায়ক

যেদিন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে প্রথম দেখি সেই দিনটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। চুয়াত্তর সালের শুরুর দিক। আমি জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। একটা-দুটো লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে সাহিত্য পড়ি বেশি। ওসব নিয়েই আছি। বিকাল কাটে গ্লোরিয়ার সীমান্ত গ্রন্থাগারে বই পড়ে। জগন্নাথে কি একটা উৎসব হচ্ছিল। নিচতলার পশ্চিম-উত্তর দিককার বিল্ডিংটার একটা বড় রুমে বাংলা বিভাগ দেয়াল ভর্তি করে রেখেছে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার বড় লেখক পি তদের নানারকম উদ্ধৃতি লিখে। আমরা কয়েক বন্ধু সেই রুমটায় ঢুকেছি। উদ্ধৃতিগুলো পড়ছি। আমার খুব ভালো লাগছিল কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে সেটা। বোর্ডটার সামনে দাঁড়িয়ে দু-তিনবার লেখাটুকু পড়লাম। হঠাৎ একজন পেছন থেকে বললেন, কেমন লাগছে? ফিরে তাকিয়ে দেখি রাজপুরুষের মতো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স একত্রিশ-বত্রিশ। মাথাভর্তি কোঁকরানো চুল। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা। চেহারায় প্রবল আভিজাত্য এবং ব্যক্তিত্ব। মুখের দিকে তাকালেই সমীহ জাগে। নিশ্চয়ই আমাদের কোনো শিক্ষক হবেন। বললাম, ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ সবচাইতে ভালো লাগলো। তিনি হাসলেন, কেন বলতো? আমি একটু ফাঁপরে পড়লাম। কী ব্যাখ্যা করব? কোনো রকমে বললাম, লেখার ভঙ্গিটা অন্যরকম।

শুধু এটুকুই। তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন। বন্ধুরা আমাকে বলল, উনি হচ্ছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যার। বাংলার টিচার।

ইন্টারমিডিয়েটের বাংলা ক্লাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আমি কখনো পাইনি। আমাদের বাংলার ক্লাস তিনি নিতেন কিনা জানি না। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে ভালোমতো পরিচয় হলো। আমি গল্প লিখছি, আর তখনকার উঠতি তরুণ লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। যেমন বুলবুল চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, ফিউরি খন্দকার। বুলবুল এবং সিরাজের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সিরাজ বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। নারিন্দার স্বামীবাগে বাড়ি। সিরাজের বন্ধু হচ্ছে হেলাল। একই পাড়ায় বাড়ি। হেলাল জগন্নাথে বাংলায় অনার্স পড়ে। আমার আরেক বন্ধু নারায়ণগঞ্জের মুজিবুল হক কবীর জগন্নাথে বাংলায় পড়ে এবং কবিতা লেখে এইসব বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা শুরুর পরেই দেখলাম তারা সবাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একাধারে ছাত্র এবং মহাভক্ত। ওরা সবাই তাকে স্যার স্যার করে। আমি ততদিনে জগন্নাথে ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছি। ইলিয়াস স্যারকে হঠাৎই ভাই ডাকতে শুরু করলাম। দিনে দিনে তিনি আমাদের বন্ধু হয়ে উঠলেন। থাকতেন বাংলা ভাষার আরেক বড় লেখক শওকত আলী স্যারের হাটখোলা রোডের বাড়ির নিচতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে। তারপর চলে গিয়েছিলেন শওকত আলী স্যারের বাড়ি থেকে সোজা পুবদিকে রোজ গার্ডেনের কাছাকাছি একটা বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটে। বেশ অনেকগুলো বছর সেই বাড়িতে তিনি ছিলেন। রাস্তা থেকে ইট বিছানো পথে উত্তর দিকে বেশ খানিকটা হেঁটে গেলে সেই বাড়ি। বুলবুল, সিরাজ, হেলালদের সঙ্গে মুজিবুল হক কবীর আর আরিফদের সঙ্গে ওই বাড়িতে কত বিকাল সন্ধ্যা আড্ডা দিয়েছি আমরা। ইলিয়াস ভাই বগুড়ায় গেলে সেই বাড়ি পাহারাও দিয়েছি। রাতের বেলা দলবেঁধে থেকেছি, হইচই, করেছি। এই লেখা লিখতে বসে মনে পড়ছে সেইসব দিনের কথা।

আড্ডায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তুলনা ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন। চা আর পাইপ টানতেন। হা হা করে হাসতেন। অতুলনীয় রসবোধের অধিকারী। আড্ডা দেওয়ার জন্য অনেকগুলো জায়গা ছিল তাঁর। বাংলাবাজারের বিউটি বোডিং, নবাবপুরের হোটেল আরজু, গুলিস্তানের রেক্স রেস্টুরেন্ট। বন্ধু-বান্ধবও ছিল প্রচুর। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, খালেদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ। ‘গুলসিতান’ রেস্টুরেন্টেও আড্ডা দিতেন। বুড়োভাই, বিপ্লব দাস, প্রশান্ত ঘোষাল আড্ডার সঙ্গী ছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় যেমন ছাত্রদের সঙ্গেও তেমন। একসঙ্গে চা-সিগারেট চলছে। হাসি-ঠাট্টা-মশকরা চলছে। তাঁর কে এম দাস লেনের ফ্ল্যাটেই বেশিরভাগ আড্ডা হয়েছে আমাদের। একটানা পাঁচ-সাত ঘণ্টা, কখনো সারা রাত, তাঁর পড়াশোনা ব্যাপক। ইউরোপীয় সাহিত্যের পি ত বলা যায়। সব রকমের বিষয় নিয়ে আড্ডা দিতেন। সিনেমা প্রেম সংগীত সাহিত্য শিল্প, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন কোনোটাই বাদ যেত না। একটা বিষয়ে তিনি ছিলেন কঠিনতম মানুষ। লেখা ভালো না লাগলে সেই লেখক তাঁর যত প্রিয় মানুষই হন কখনো তার লেখার প্রশংসা করতেন না। একটি উদাহরণ দিই। আমরা একবার তাঁকে এক লেখক সম্পর্কে ধরলাম। সেই লেখক ইলিয়াস ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ। নামটা আমি উহ্য রাখছি। কথাটা বোধহয় হেলাল তুলেছিল। সেই লেখকের নাম ধরে বলল, তিনি লেখেন কেমন? তার লেখা আমার কেমন লাগে। ইলিয়াস ভাই বললেন, সে মানুষ খুব ভালো। তারপর কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর হেলাল আবার বলল, তার লেখা কেমন? ইলিয়াস ভাই পাইপ টানতে টানতে বললেন, বললাম তো সে লোক খুব ভালো। তারপর আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। হেলাল নাছোড়বান্দা। কিছুক্ষণ পর আবার বলল, বললেন না তিনি লেখেন কেমন? ইলিয়াস ভাই খুবই সিরিয়াস মুখ করে বললেন, না না তুমি বুঝতেই পারছ না সে লোক খুব ভালো।

আমরা হাসতে লাগলাম। বুঝে গেলাম তিনি ওই লেখকের লেখা নিয়ে কথা বলবেন না।

আমাদের হেলাল পরে আত্মহত্যা করে। তাঁর এই প্রিয় ছাত্র ও বন্ধুটিকে ‘দোজখের ওম’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন ইলিয়াস ভাই।

১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর।’ সেই বই বোদ্ধা পাঠক মহলের কলকব্জা নাড়িয়ে দিল। রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘সংবর্ত’ লিটল ম্যাগাজিনে এই বইয়ের সমালোচনা লিখলেন হাসান আজিজুল হক। তাঁর লেখায় নাম ছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিষবৃক্ষ।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন খুব কম। মাত্র ২৮টি গল্প, ২টি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধ সংকলন। কিন্তু তিনি নিজেকে বলতেন ২৪ ঘণ্টার লেখক। শিক্ষকতা করছেন, পাইপ টানছেন, বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা দিচ্ছেন, কাঁধে ঝোলা, পরনে প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট। সবার মধ্যে থেকেও আলাদা হয়ে গেছেন। পুরান ঢাকার প্রতিটি গলিগুচি নিজের হাতের তালুর মতো চিনতেন। কোন গলির কি নাম তা মুখস্থ ছিল। ঢাকাইয়া ভাষাটা অসাধারণ জানতেন। এক সময় কিছুদিন গে ারিয়ায় থেকেছেন। ফরিদাবাদ পোস্ট অফিসের ঠিক উল্টোদিকে ছিল তাঁর বন্ধু শাকের চৌধুরীদের বাড়ি। সেই বাড়ির নিচতলায় শাকের চৌধুরীর একটা ওষুধের দোকান ছিল। ওখানেও যেতেন কখনো কখনো আড্ডা দিতে। পঁচাত্তর সালে দৈনিক সংবাদে লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস। নাম ছিল ‘চিলেকোঠায়’। সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল সেই উপন্যাস। সরকার পরিবর্তনের পর উপন্যাসের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয় পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। এই উপন্যাসই ‘চিলেকোঠার সেপাই’ নাম দিয়ে ’৮১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায়। দু-বছর ধরে লিখে সেই উপন্যাস শেষ করেছিলেন। রোববার পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল আটাত্তর সালের শেষদিকে। আমি সেখানে জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতাম। নির্বাহী সম্পাদক রফিক আজাদ। ইলিয়াস ভাইয়ের বাসার কাছে ইত্তেফাক ভবনে অফিস। তিনি প্রায়ই আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতেন। রোববারের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সংখ্যায় লিখেছিলেন তাঁর ‘মিলির হাতে স্ট্যানগান’ গল্পটি। ঊনআশি থেকে একাশি সাল পর্যন্ত আমি ছিলাম জার্মানিতে। সেখানে বসে রোববারের ঈদ সংখ্যায় পড়লাম তাঁর ‘দুধ ভাতে উৎপাত’ গল্পটি। সেই সংখ্যায় সম্ভবত আমার ‘কালোঘোড়া’ উপন্যাসটিও ছাপা হয়েছিল। ‘কালোঘোড়া’ জার্মানিতে বসে লিখেছিলাম। ‘গাহে অচিন পাখি’ গল্পটিও ওখানে বসেই লেখা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য বিচার করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে আমি তাঁর সব লেখা পড়েছি। কোনো কোনো লেখা দু-তিনবারও পড়েছি। মনে আছে একবার ‘খোয়াবনামা’ ও মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেট ইয়ার্স অব সলিচিউট’ পাশাপাশি পড়েছিলাম। পড়ে মনে হয়েছিল দুজন প্রায় একই রকমের মেধাবী লেখক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ইংরেজি কিংবা স্প্যানিশ ভাষায় জন্মালে, ফরাসি কিংবা জার্মান ভাষায় জন্মালে পৃথিবী তাঁকে মাথায় তুলে রাখতো।

ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর কলকাতায় চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর ভক্ত পাঠক প্রচুর। গায়ক কবীর সুমন প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতেন। ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেলেন কিন্তু পুরস্কারটি তিনি গ্রহণ করতে চাইলেন না। পুরস্কার কমিটিতে আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন। আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ স্যারকে পাঠালেন ইলিয়াস ভাইয়ের কাছে। তিনি ইলিয়াস ভাইকে পুরস্কার নিতে রাজি করালেন। পুরস্কারের টাকাটা তাঁর চিকিৎসার কাজে লেগেছিল।

ক্যান্সারের কারণে তাঁর একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। ঢাকায় ফেরার পর একদিন তাঁকে দেখতে গেছি। গিয়ে বিস্মিত। তিনি বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আগের মতোই আড্ডা দিচ্ছেন। শরীরে ক্যান্সার, পা কাটা পড়েছে, তোয়াক্কাই করছেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার রাতে ঘুম হয়? নির্বিকার গলায় বললেন হয়। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে কাটা পায়ের দিকে একটা হাত চলে যায়। তখন ফিল করি পা-টা নেই। এমন মনের জোর হতে পারে মানুষের। কলকাতার ডাক্তাররাও তাঁর মনের জোর দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।

বাংলাবাজারে গেলে মাওলা ব্রাদার্সে বসতেন। মাহমুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। মাওলা ব্রাদার্স তাঁর প্রকাশক। ওখানে একদিন আমার সঙ্গে দেখা। আমার ‘ভূমিপুত্র’ উপন্যাসটি তাঁর খুব পছন্দ ছিল। সেই প্রসঙ্গ ধরে বললেন, আবোল-তাবোল লিখে ভালো হাতটা নষ্ট করো না। ইলিয়াস ভাই যেদিন চলে গেলেন ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭। আমি সেদিন হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে কক্সবাজারে। ফরীদি সিনেমার শুটিং করে আর আমি হোটেলে বসে নাটক লেখার চেষ্টা করছি। শুটিং শেষ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসে ফরীদি। দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দিই। ৪ জানুয়ারি দুপুরবেলা হোটেলে ফিরে এলো ফরীদি। আমি অবাক। ফরীদির মুখটা বিষণœ। ধরা গলায় বলল, একটা দুঃসংবাদ আছে। শুনে কান্নাকাটি করিস না। ইলিয়াস ভাই চলে গেছেন। বলে নিজেই হু হু করে কাঁদতে লাগলো।

বাংলা সাহিত্যের এক মহিরূহ মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দারুণ ভক্ত। তিনি লিখেছিলেন, ‘ইলিয়াসের পায়ের নখের যোগ্য কোনো লেখা লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম। ‘খোয়াবনামা’ শেষ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা ছিল ইলিয়াস ভাইয়ের। তাঁর অকাল মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হলো এক অমর উপন্যাস থেকে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর