বুধবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ইশতেহারের সত্যিকার বাস্তবায়ন চান সবাই

সরকারের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ► আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ► মাদক নিয়ন্ত্রণ ► হুন্ডি বন্ধ ► মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাচার বন্ধ ► দুর্নীতি বন্ধ ► ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ► আর্থিক খাতের সংস্কার ► বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ► ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরা ► তারুণ্যের প্রত্যাশা পূরণ ► আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা

জুলকার নাইন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের সামনে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ। রয়েছে মেগা প্রকল্পগুলো প্রতিশ্রুত সময়মতো বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা, দুর্নীতি বন্ধ করা, মাদক নিয়ন্ত্রণ, হুন্ডি বন্ধ করা, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে টাকা পাচার বন্ধ করা, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আনা, আর্থিক খাতের সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের লাগাম টেনে ধরা এবং তারুণ্যের প্রত্যাশা পূরণ করে কোটা সংকটের স্থায়ী সংস্কার ও সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিষয়। অবশ্য এরই মধ্যে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। সেই সঙ্গে নিজ দলের নেতাদের সতর্ক করে দিয়েছেন- যেন ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পদ বানানোর হাতিয়ার না করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, কোনো দল যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা দেখা দেয় তা হলো- ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ। নতুন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হবে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে উৎসাহিত করা। নির্বাচনের পরপরই নোয়াখালীর সুবর্ণচরে একটি ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে ধর্ষককে আটক করা হয়েছে। সরকারি দলের দায়িত্বশীল নেতারা বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন। এরপর এ ধরনের পরিস্থিতি যেন আর না আসে, সে বিষয়ে তৃণমূলে কঠোর বার্তা দেওয়া প্রয়োজন। গত দুই মেয়াদে পুলিশের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। বিশেষ করে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার ও বিভিন্ন মামলায় সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়াও প্রতিনিয়ত পুলিশের হাতে হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগও করেছেন অনেকেই। নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা- সুশাসন নিশ্চিতে পুলিশ বাহিনী আরও জনবান্ধব হবে। পাশাপাশি পেশাগতভাবে পুলিশকে আরও বেশি দায়িত্বশীল করার তাগিদও আছে বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে তা আরও কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে হবে। পুলিশের ভিতরেও অনেকের মাদক সংশ্লিষ্টতা বা পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আছে, এটাকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের যে বিশাল চক্র কাজ করছে, তাদের লাগাম টেনে ধরতেও পুলিশকে বিশেষ লড়াইয়ে নামতে হবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আর্থিক খাতে আস্থা ফেরাতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। আওয়ামী লীগের গত দুই মেয়াদে শেয়ারবাজারে ধস এবং ব্যাংকিং খাতে নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরাতে সরকারের শুরু থেকেই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে বড় পরিমাণের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে, সে বিষয়েও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আয় বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর সময়মতো বাস্তবায়ন করাটাও সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পদ্মা বহুমুখী সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা রেল সংযোগ, পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কক্সবাজার দোহাজারী রেলপথ প্রকল্পসহ মেগাপ্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন দেখতে চায় দেশবাসী। সরকার আশা করছে, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে রূপপুরের ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। পরের বছর চালু হবে সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট। রূপপুরের প্রকল্প এলাকায় ১ হাজার ৬২ একর জমির ওপর এখন চলছে বিপুল কর্মযজ্ঞ। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের মতে, এত বড় ব্যবধানের জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসায় আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা চান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ইশতেহারে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, তা যেন সত্যিকার অর্থে প্রতিফলিত হয়। অর্থনীতিবিদ খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই বক্তৃতায় বলেছেন তিনি আয় বৈষম্য কমিয়ে আনবেন। এটাই হবে তার সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার যখন ১০ বছর আগে ক্ষমতায় এসেছিল, তখন আয়ের বৈষম্যের পরিমাপক ছিল দশমিক তিন চার। এখন সেই বৈষম্য দাঁড়িয়েছে দশমিক চার আট। সাবেক তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খানের মতে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। গণতন্ত্রের গড়ন বা কাঠামো প্রায় ভেঙে গেছে। কাঠামো নতুন করে গড়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ কাজ যদি সঠিকভাবে করা না হয়, তাহলে আগামী দশকগুলোতে আমাদেরকে এর দায় বহন করতে হবে। গণতন্ত্রের কাঠামো নতুন করে গড়ার জন্য আমাদের অনেক কিছু করতে হবে- যেমন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। অবশ্য আইনের শাসনের জন্যও প্রয়োজন বড় ধরনের সংস্কারের। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে ৫০ বছর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূল্যায়ন আজও একইভাবে প্রযোজ্য। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের বিচারব্যবস্থায় নতুন করে আইনকানুন করতে হবে, নতুন করে কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। সেগুলো করার জন্য বিরাট পরিবর্তনের প্রয়োজন। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের মতে, চ্যালেঞ্জ নয় বরং নতুন সরকারের সামনে অনেক সুযোগ রয়েছে। দেশে যে উন্নয়নের ধারা চলছে তা ধরে রাখতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারে। এ জন্য দেশে বাণিজ্যিক পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে সংস্কারও করা প্রয়োজন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ, অর্থাৎ কর আদায়ের ব্যাপারে সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। কারণ রাতারাতি উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য অর্থের প্রয়োজন। সে কারণে অর্থ সংগ্রহ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোরও চেষ্টা করতে হবে সরকারকে। শিক্ষা, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে যাতে বিদেশি বিনিয়োগ আরও বাড়ে, সেজন্য প্রয়োজনীয় আকর্ষণীয় পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। সুশাসন নিশ্চিত না হলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে। সবার অংশীদারিত্ব নিয়ে এগোতে পারলে রাষ্ট্র টেকসই উন্নয়নের চেহারা পাবে। 

 

সর্বশেষ খবর