শুক্রবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

সেলিম আল দীন প্রিয় অগ্রজ

ইমদাদুল হক মিলন

সেলিম আল দীন প্রিয় অগ্রজ

সেলিম আল দীনকে নিয়ে কত কথা লেখার আছে। কেমন করে লেখা যায় বুঝে উঠতে পারছি না। আফজাল ও আরেফিনের প্রতিষ্ঠান মাত্রা। সেই প্রতিষ্ঠানের একটা প্রজেক্ট ছ-সাত বছর এডভাইজার হিসেবে ছিলেন সেলিম ভাই। এইডসের বড় ক্যাম্পেইন চলছিল। সেলিম ভাই একটি যুগান্তকারী স্লোগান তৈরি করে দিলেন- ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’। মাত্রা থেকে গাড়ি কিনে দেওয়া হলো সেলিম ভাইকে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্বের শিক্ষক। সেখানকার কোয়ার্টারে থাকেন। বাসে করে আসা-যাওয়া করতেন দেখে আফজাল আরেফিন গাড়িটা কিনে দিল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সপ্তাহে এক-দুদিন তিনি আসতেন। সেই গাড়ির ফিটনেস করাতে গেছেন। ওখানে বোধহয় পাসপোর্ট দেখাবার ব্যাপার ছিল। বহুদিন পাসপোর্ট খুলে দেখেননি। ওখানে গিয়ে দেখেন ডেড এক্সপায়ার করে গেছে। এই পাসপোর্ট আর কী কাজে লাগবে? অপ্রয়োজনীয় কাগজের মতো গাড়ির জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। এসবের কয়েক দিন পর জীবন নামের পাসপোর্টটি তিনি বন্ধু ছাত্রছাত্রী এবং হাজার হাজার ভক্তের মাঝখানে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। অথচ সেলিম আল দীনের মৃত্যুভীতি ছিল ভয়ানক। প্লেনে চড়তে অসম্ভব ভয় পেতেন। একবার কলকাতা যাওয়ার সময় প্লেন থেকে শিশুর মতো চিৎকার করতে করতে নেমে গিয়েছিলেন।

আমার বন্ধুরা সবাই সেলিম ভাইকে আপনি করে বলত। শুধু সুবর্ণা আর আমি বলতাম তুমি করে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ‘স্বর্ণবোয়াল’ নামে সেলিম ভাই একটি উপন্যাস লিখলেন। ছাপা হলো ‘নিপুণ’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়। ওই পত্রিকার মালিক সম্পাদক তখন আজকের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আমাদের আরেক প্রিয় অগ্রজ মোস্তাফা জব্বার। পত্রিকা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর মাত্রার অফিসেই সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বললেন, চল তো আমার সঙ্গে উপন্যাসের বিলটা নিয়ে আসি। মাত্রা অফিস তখন মতিঝিল থানার উল্টো দিককার গলিতে। জব্বার ভাইয়ের অফিস আরামবাগে। রিকশা নিয়ে রওনা দিয়েছি দুজনে। সেলিম ভাই খুবই চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, উপন্যাসের বিল কত চাওয়া যায় বলতো? বললাম, দেড়-দুই হাজার টাকার কম না। খুব খুশি। লিখে এত টাকা পাওয়া যায়? তারপর কী রকম একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন। আমি আবার মনে করিয়ে দিলাম, তুমি কিন্তু দেড় হাজার টাকার কম নিও না। আমাকে একটা ধমক দিলেন। এত কথা বলিস না তো। আমার মনে আছে।

নিপুণ অফিসে সরাসরি জব্বার ভাইয়ের রুমে গেলাম। আমাদের খুবই ভালোবাসেন এই মানুষটি। নিপুণের প্রথম ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস লেখার জন্য চার দিন আমাকে একটা ঘরে আটকে রেখেছিলেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রচুর খাবার। আমি নিশ্চিন্ত মনে উপন্যাস লিখে গেলাম। বাংলাদেশে প্রথম ফটোকম্পোজে সেই ঈদসংখ্যা ছাপা হয়েছিল। সেলিম ভাই আর আমাকে দেখে জব্বার ভাই উচ্ছ্বসিত। প্রচুর খাবার আনালেন। খাওয়া শেষ করে চায়ে চুমুক দিলেন সেলিম ভাই। হঠাৎ করেই বললেন, জব্বার ভাই, উপন্যাসের জন্য আমাকে কিন্তু পাঁচশো টাকার কম কিছুতেই দেওয়া যাবে না। আমি হতভম্ব। কী শিখিয়ে আনলাম আর সেলিম ভাই কী বলছেন! তার মানে রিকশায় আসতে আসতে আমরা যে আলোচনা করেছিলাম পুরোটাই তার মাথা থেকে উধাও হয়ে গেছে। কোথায় দেড় হাজার চাইবেন, চাইলেন পাঁচশো। আশ্চর্য ব্যাপার জব্বার ভাই কিন্তু তাকে দেড় হাজার টাকাই দিলেন। জব্বার ভাইকে যারা চিনেন তারা জানেন হাসিটি সব সময় তার মুখে লেগেই আছে। হাসিমুখে বললেন, না না পাঁচশো কেন?  আপনার জন্য আমি দেড় হাজার টাকা রেখেছি। সেলিম ভাই বিস্মিত। লিখে এত টাকা পাওয়া যায়?

দুজন মানুষকে খুব ভয় পেতেন সেলিম আল দীন। একজন তার বন্ধু নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু আরেকজন অভিনেতা আফজাল হোসেন। বাচ্চুভাই কথা বললে সে কথা মনোপুত না হলে একটু গোঁ গোঁ করতেন কিন্তু মেনে নিতেন। আফজালের ক্ষেত্রেও তাই। খুব সিগারেট খেতেন। আফজাল সিগারেট খাওয়া পছন্দ করে না। মাত্রায় এলে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতেন। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দে। আফজাল যেন না জানে। সেলিম ভাইয়ের প্রতি আমার বেশি টানের আরেকটা কারণ রফিক আজাদ। সেলিম ভাইকে নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন রফিক ভাই আর আমাকে শিখিয়েছিলেন লেখালেখির মন্ত্র। আমরা দুজনেই রফিক আজাদকে বাবা ডাকতাম। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় বা তারও কিছু পরে ফরীদি জাহাঙ্গীরনগরে পড়ছে। ঢাকা থেকে আমরা মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে যেতাম। সেলিম ভাই তখন জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষক হয়েছেন। কোয়ার্টারে থাকেন। সেই কোয়ার্টারের ড্রয়িংরুমে সারা রাত আড্ডা চলছে দশ-বারোজন যুবকের। সেলিম ভাইয়ের স্ত্রী পারুল ভাবী খিচুড়ি রান্না করে দিচ্ছেন। দল বেঁধে খাওয়া চলছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা দিচ্ছেন ভাবী। চা-সিগারেট চলছে। সে এক অ™ভুত জীবন। এখনো পরিষ্কার দেখতে পাই সেই দিনগুলো।

লিখতে বসলে মুখ দিয়ে হুম হুম এক ধরনের শব্দ হতো সেলিম ভাইয়ের। যেন লিখছেন না যেন তিনি শ্রমিকের কাজ করছেন। কঠিন পাথর ভাঙার জন্য গাঁইতি চালাচ্ছেন। লিখছেন, পছন্দ হলো না দলামোচরা করে ছুড়ে ফেললেন। সেই কাগজের দিকে তাকিয়েও দেখছেন না। কিন্তু পারুল ভাবী ওই ফেলে দেওয়া কাগজ অতিযতেœ সংরক্ষণ করছেন। সেলিম ভাইয়ের ডায়াবেটিস ছিল। কেয়ারই করছেন না। মিনিটে মিনিটে সিগারেট খাচ্ছেন, চা খাচ্ছেন। শরীরের কথা জিজ্ঞেস করলেই রেগে যেতেন। দেখছিস না কত ফ্রেশ লাগছে আমাকে। আজ সকালেও তো দেড়ঘণ্টা হেঁটেছি। ফাঁকি, ফাঁকি! ভিতরে ভিতরে শরীরটাকে তিনি ক্ষয় করে ফেলেছিলেন। শরীরের ভিতরকার সবটুকু আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল। ল্যাবএইডের ডাক্তাররা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। আইসিইউতে অচেতন হয়ে আছেন সেলিম আল দীন। হাসপাতালের সামনে হাজার মানুষের ভিড়। বাচ্চুভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ব্যাংককে নিয়ে যাবেন। পাসপোর্ট তো সেই কবে ফেলে দিয়েছিলেন সেলিম ভাই। রাতারাতি নতুন পাসপোর্ট করা হলো। ষাট-সত্তর লাখ টাকা জোগাড় হয়ে গেল। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রেডি। ব্যাংককে প্রস্তুত হাসপাতাল। কাউকে কোনো সুযোগ দিলেন না সেলিম আল দীন। রাতের অন্ধকারে সন্ন্যাসীর মতো পালিয়ে গেলেন। আমার ‘গল্প সমগ্র-১’ সেলিম আল দীনকে উৎসর্গ করা। বইটি বেরুবার কয়েক দিন আগে তিনি চলে গেলেন। সেই বই সেলিম ভাইয়ের হাতে আর পৌঁছে দেওয়া গেল না। আমার একটা গল্প আছে ‘গাহে অচিন পাখি’। গল্পটা সেলিম ভাই খুব পছন্দ করতেন। গল্প পড়ে আমাকে একদিন বললেন, এই গল্পটা বিটিভিতে আমি নাটক করব। তুই পারবি না। এটার নাট্যরূপ দিতে হবে আমাকে। আমার খুব মজা লেগেছিল। আমার গল্প আমিই নাকি নাট্যরূপ দিতে পারব না, সেলিম ভাই পারবেন। এরকম কত দিনকার কত স্মৃতি। সেলিম ভাই ছিলেন মঞ্চ আলোকিত করা মানুষ। ‘কেরামত মঙ্গল’ ‘হাতহদাই’ ‘চাকা’ ‘বনপাংশুল’ তার প্রতিটি নাটকই বাংলা নাট্য সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি বাংলা নাটকের আচার্য। আচার্য সেলিম আল দীন। বাংলা নাটকের মঞ্চ চিরকাল আলোকিত হয়ে থাকবে সেলিম আল দীনের আলোয়। জীবনের মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েও তিনি আসলে মঞ্চের মাঝখানেই রয়ে গেছেন। মৃত্যু সেলিম আল দীনকে একটুও ম্লান করতে পারেনি।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর