রবিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভুলের হিসাব মেলাচ্ছে বিএনপি

নির্বাচনের তথ্য সংগ্রহ নিয়ে বিপত্তি, সামনে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চ্যালেঞ্জ

বিশেষ প্রতিনিধি

ভুলের হিসাব মেলাচ্ছে বিএনপি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি শুরু থেকেই কৌশলগত অসংখ্য ভুলের চোরাবালিতে আটকে ছিল বলে মনে করছেন দলের অনেক নেতা-কর্মী। সেই ভুলের খেসারত হিসেবেই নির্বাচনে দলের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনে বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে তৃণমূল পর্যায়ের হতাশ নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার উপায় খুঁজছে বিএনপি।

নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কয়েক দফা বৈঠক করে তাগিদ দেওয়ার পরও নির্বাচনে অনিয়মের প্রত্যাশিত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি দলটি। ফলে সরকারের বিরুদ্ধে কোন কৌশল নিয়ে সামনে এগোবে তা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। ভোটের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল সংগ্রহ নিয়েও বিপাকে রয়েছে দলটি, যার ভিত্তিতে আদালতে মামলা করার কথা ছিল। সূত্রমতে, নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকেই মাঠ ছেড়ে দেওয়া বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের শুরু থেকেই কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। তারা কী প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করবে, কীভাবে সরকার গঠন করবে, কে তাদের মুখ্য নেতৃত্বে থাকবেন- তা মোটেও সুনির্দিষ্ট ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেতারা অনেকটা হাত-পা ছেড়ে বসে ছিলেন। বিএনপির হাইকমান্ডসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতারা কর্মীদের উদ্দেশে ভোট কেন্দ্র পাহারা ও সকালে ভোটের বাক্স পরীক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া কেন্দ্রভিত্তিক ভোট রক্ষা কমিটির করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের সাড়া মেলেনি। ভোটের কয়েকদিন আগে থেকে ধানের শীষের প্রার্থীরা মাঠ ছেড়ে দেন। বিএনপির অনেক প্রার্থী প্রচারণায় নামেননি। এমনকি পোস্টারও ছাপেননি। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ অনেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই চলে আসেন মাঠের বাইরে। বিএনপি নেতাদের প্রচারণা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মূলত ফেসবুককেন্দ্রিক ছিল। তারা আশা করছিলেন, ধানের শীষের পক্ষে ‘একটি ভোট বিপ্লব’ হয়ে যাবে। বিএনপির পক্ষে নীরব ভোট বিপ্লব ঘটবে। কিন্তু দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে না থাকায় সমর্থকরাও তেমন সাড়া দেননি।

তথ্য সংগ্রহ নিয়ে বিপাকে বিএনপি : নির্বাচনে অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ নিয়ে বিপাকে রয়েছে বিএনপি। প্রতিটি নির্বাচনী আসনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল সংগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন দলের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড। তার ভিত্তিতেই প্রতিটি সংসদীয় আসনের ভোট কেন্দ্রভিত্তিক অভিযোগ দায়ের করার কথা ছিল। কিন্তু সেই ফলাফল পাচ্ছেন না বিএনপির প্রার্থীরা। কারণ, নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ফলাফল পেতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। অন্যদিকে প্রার্থীর এজেন্টদের কাছ থেকে ফল পাওয়াও অনেক কঠিন। অধিকাংশ কেন্দ্রে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের এজেন্টই ছিল না। সূত্রমতে, স্থানীয়ভাবে ফলাফল সংগ্রহ করে অভিযোগ দায়ের করাও কঠিন। কারণ, পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনের ফলাফলের সঙ্গে অভিযোগের ফল না মিললে অভিযোগই খারিজ হয়ে যেতে পারে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা মনে করেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের আচরণে নিরপেক্ষতার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে হেরে গেছে বিএনপি। এসব কারণে তারা নির্বাচনের আগে কার্যকর প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। নির্বাচনের বেশ আগেই তাদের মাঠ ছেড়ে দিতে হয়। অন্যদিকে বিএনপি ভোটের আগের রাতে প্রশাসনের সহায়তায় ব্যালট বাক্স ভর্তি করার অভিযোগ করলেও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারছে না। নির্বাচনের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও ঐক্যফ্রন্টের একাধিক বৈঠক হয়েছে। সেখানে নির্বাচনে অনিয়মের বিভিন্ন বিষয় ও ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন নেতারা। কিন্তু অপর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কত দূর এগোনো যাবে তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বিএনপি নেতারা।

অতিনির্ভরতার বিপদ : বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার মতে, নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্ব ছিল ঐক্যফ্রন্টের হাতে, যার চূড়ান্ত ‘অপব্যবহার’ হয়েছে। বিএনপি নেতাদের নির্ভরতা ছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের ওপর। শুরুতে নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তা নিয়ে দলে বিভক্তি ছিল স্পষ্ট। এক পক্ষ প্রকাশ্যেই বলতে থাকেন দলের কারাবন্দী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর গ্রেফতার-হামলা বেড়ে গেলে প্রতিকূল পরিবেশের অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের পক্ষে একটি অংশ শক্তভাবে অবস্থান নেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, কেন্দ্রীয় নেতা নাজিম উদ্দিন আলম, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ অনেকে প্রকাশ্যে নির্বাচন বর্জনের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকার পক্ষে ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেনসহ কয়েকজন নেতার জোরালো অবস্থানের কারণে তা সফল হয়নি। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, ওদের বেআইনি কোনো আদেশ মানবেন না। ক্ষমতায় তো সরকার পাঁচ বছর থাকে। সেই পাঁচ বছর শেষ। আর কয়দিন আছে। মাত্র ১০, ২০ বা ১৫ দিন। অন্যদিকে নির্বাচনের দেড় সপ্তাহ আগে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, ৩০ জানুয়ারি নির্বাচন হবে আর আগামী ২ জানুয়ারি বেগম জিয়া মুক্তি পাবেন। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে নয়, ভোর ৫টা থেকে জনগণ ভোট কেন্দ্রে যাবে, সরকারের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। নৌকা ডুবে যাবে ৩০ তারিখ। তবে নেতাদের এসব বক্তব্য শেষ পর্যন্ত বাগাড়ম্বরে পরিণত হয়। বিএনপি নেতারা এসব বক্তব্যে উদ্দীপ্ত হলেও ধানের শীষের সমর্থকরা ভরসা পাননি। অন্যদিকে ড. কামাল ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এমন বক্তব্যের পর সরকার তার অবস্থান সুদৃঢ় করে।

সামনে বিভক্তির ভয়, ঐক্য রক্ষার তাগিদ : বিএনপির সামনে এখন দলে বিভক্তির বিপদ। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বর্জন নিয়ে নেতাদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ভোটে যাওয়ায় বিএনপির একাংশ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ভরাডুবির পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের প্রথম বৈঠকে দেখা যায়নি নির্বাচনে যাওয়ার বিরোধিতাকারী অনেক নেতাকে। বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আর কোনো নির্বাচনে এতটা খারাপ ফল হয়নি বিএনপির। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সরকার আমাদের অবস্থা দুর্বল করেছে। এদিকে নির্বাচনে চরম ভরাডুবির পর নিজের অবস্থা টিকিয়ে রাখতে বিএনপি এখন কী কৌশল নেবে- তা নিয়েই সর্বত্র আলোচনা চলছে। দীর্ঘ ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতারা আগামী দিনের করণীয় নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনাও শুরু করেছেন। দলের নীতিনির্ধারকদের মতে, বিএনপির সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। দল ইতিমধ্যে নির্বাচন ও ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সঙ্গে নেতারা নতুন নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছেন। এ দাবি নিয়ে তারা জনগণের কাছে যাবেন। ইতিমধ্যে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এদিকে আগামী পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ সরকারে থাকবে মেনে নিয়েই সামনে এগোতে হচ্ছে বিএনপিকে। এই সময়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখাই বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা এখনো ছন্নছাড়া। গভীর হতাশায় নিমজ্জিত এসব নেতা-কর্মী লাখো মামলার আসামি। নির্বাচনের পরও অনেক এলাকায় এখনো স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসেনি। অনেকেই মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে কারাগারে ঢুকছেন। মামলা-হামলাসহ নানামুখী নির্যাতন ঠেকাতে অনেকেই এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সমঝোতার চেষ্টা করেও ব্যর্থও হচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকেই প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। কেউ কেউ গোপনে সম্পর্ক রেখে এলাকায় ফিরে গেছেন। বিএনপির যুগ্মমহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের পুরনো সব কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। সেই নতুন চিন্তার মধ্যে এ প্রজন্মকে গুরুত্ব দিতে হবে। নেতা-কর্মীদের চেয়েও তাদের মতামত বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা তৈরি হবে।’ বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের এখন একটাই কাজ হবে- নেতা-কর্মীদের এক প্ল্যাটফরমে রাখা। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, হামলা-মামলার শিকার হয়ে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এখনো হতাশায় ভুগছেন। এজন্য তৃণমূলকে উজ্জীবিত রাখার কর্মসূচি দিতে হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচিত স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটি করাও জরুরি।’

সর্বশেষ খবর