সোমবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বেপরোয়া খেলাপি ঋণ

চলছে করপোরেট গ্যারান্টারের অশুভ সংস্কৃতি। ব্যাংকের এক মালিক করপোরেট গ্যারান্টিতে ঋণ নেন অন্য ব্যাংক থেকে। টাকা নিয়ে ফেরত দিতে চান না কেউই

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেপরোয়া খেলাপি ঋণ

করপোরেট গ্যারান্টির নামে ব্যাংকিং খাতে চলছে প্রতারণা। আইনের কঠোরতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক ব্যাংকের পরিচালকরা করপোরেট ঋণ গ্রহণ করছেন অন্য ব্যাংক থেকে। এতে থাকে না নিরাপত্তা গ্যারান্টি, দেওয়া হয় না ঋণের বিপরীতে জমি, বাড়ি কিংবা অন্য কোনো গ্যারান্টি। যার কারণে ভুয়া মানুষের নামে ব্যাংক ঋণ বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে খেলাপির পরিমাণও। আদালতে মামলা গড়ালেও তা স্থগিত করে প্রভাবশালীরা এ সুবিধা নিয়ে থাকেন। এতে করে খেলাপির পরিমাণ আরও বাড়তে থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ব্যাংক ঋণের নামে অনেক সময় জনগণের আমানত নিয়ে যা খুশি তাই করা হয়। গরিব মানুষের প্রদত্ত অর্থ ঋণ দিয়ে রাখা হয় না কোনো ধরনের সম্পদ বন্ধক। আবার ভুয়া নামে বেনামে ঋণ প্রদানের অভিযোগ রয়েছে অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে বেশিরভাগ অনিয়ম হয়ে থাকে। খেলাপিরা আদালতে আশ্রয় নিয়ে সব কিছু থামিয়ে রাখে। যে কারণে আদায় হয় না ঋণ। আবার কেউ কেউ পালিয়ে যায় বিদেশে। এতে করে সত্যিকারের বিনিয়োগকারীরা বঞ্চিত হয়। দেশের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয় বিদেশে। এসব খেলাপি অনিয়ম রোধে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সম্পদের নিরাপত্তার জন্য জোর দিয়েছেন সাবেক ব্যাংকাররা। পাশাপাশি তারা মনে করেন জবাবদিহিতা অপরিহার্য। মালিক, কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা দরকার। পাশাপাশি ঋণ গ্রহণকারীকেও রাখতে হবে কঠোর নজরদারিতে। ব্যাংকে জমা দেওয়া সব ধরনের কাগজপত্রের সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর এক পরিচালক অন্য ব্যাংকের আরেক পরিচালকের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে যাচ্ছেন। যার বিপরীতে করপোরেট গ্যারান্টি ব্যতীত অন্য কোনো মর্টগেজ বা বন্ধক থাকে না। পরবর্তীতে সে ঋণ দীর্ঘদিন অনাদায়ী থাকছে। এক সময় তা খেলাপি ঋণের তালিকায় নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। আবার এসব বিষয়ে আদালতে রিট আবেদন দাখিল করে ওইসব ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি হিসেবে ঘোষণা স্থগিত করা হচ্ছে। যার ফলে আবার একই ব্যক্তি অন্য ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এ জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া এবং আইনি দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন খোদ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ জন্য অবশ্য দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংকিং আইনকে যুগোপযোগী করার ঘোষণা দিয়েছেন নতুন অর্থমন্ত্রী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সম্প্রতি বৃহৎ অঙ্কের ঋণ নেওয়া ব্যাংক খাতের শতাধিক গ্রহীতার হদিস মিলছে না। নামে বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে তারা গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকে আবার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। এসব ঋণগ্রহীতাকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। একদিকে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে এসব ঋণগ্রহীতার মর্টগেজ দেওয়া কাগজপত্রও ভুয়া। এই প্রতারক ঋণগ্রহীতারা ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে বলে জানা গেছে। এমন প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় খাতের কিছু ব্যাংক পরিচালক। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ থাকতে পারে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দশম জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও এসব ঋণগ্রহীতার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানা গেছে, সঠিক নজরদারির অভাবে ঋণ জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সাম্প্রতিক সময় ঋণ জালিয়াতির এক অভিনব পদ্ধতি হচ্ছে একটি কোম্পানির সব ধরনের কাগজপত্র সঠিকভাবে উপস্থাপন করে ঋণ দেওয়া হয়। ওই কোম্পানির বিপরীতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনুমোদন অতিরিক্ত অর্থ তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি পুরোপুরি ভুতুড়ে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকে কানাডা প্রবাসী এক ব্যক্তির নামে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে ১০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে অডিটে বিষয়টি সামনে এলে ঋণ গ্রহণের সঙ্গে জড়িত চার ব্যক্তির নামে মামলা করা হয়। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। ঋণ জালিয়াতির আরেক পদ্ধতি এখন এসএমই। এই খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ জোর দেওয়ার কারণে কর্মকর্তারা ভুয়া মর্টগেজে ঋণ প্রদান করছে। সম্প্রতি জনতা ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই কয়েক হাজার কোটি টাকা এসএমই ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়লে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৪১৮ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক আটক করে।

এদিকে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে কোনো ঋণগ্রহীতা খেলাপি হওয়ার পর আদালতে রিট করতে চাইলে তাকে নিজ ঋণের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় এবং এ খাতে অনিম-দুর্নীতি ঠেকাতে একটি লিগ্যাল অ্যাকশন টিম গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তদারকি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার নির্দেশনাও দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর