সোমবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

মামলা হলেও আদায় হয় না

খেলাপি এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। খেলাপিদের অন্য ব্যবসা সচল

সাঈদুর রহমান রিমন

ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে খেলাপি ঋণ। জানা যায়, দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর মধ্যে আবার ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে, অর্থাৎ পাঁচ বছরেও আদায় না হওয়ায় এসব মন্দ ঋণ ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে বাদ দিয়ে আলাদা খাতায় নেওয়া হয়েছে। সরকারের দুর্বলতা, রাজনৈতিক রক্ষা বেষ্টনী ও আইনি নানা ফাঁকফোকরের মাধ্যমে খেলাপিরা পার পেয়ে যাওয়ায় দিন দিন ঋণখেলাপি, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ও ঋণ আত্মসাতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, দুদকের চিরুনি অভিযান স্টাইলেই চলে দুর্নীতি অনুসন্ধান, দায়ীদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে অন্তরীণ রাখাও নিশ্চিত হয়, কিন্তু কারও কাছ থেকে ঋণ বা আত্মসাতের টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি আর সফল হয় না। নিষ্কণ্টক-নির্ভেজাল সম্পত্তির অভাব, সরকারি সম্পত্তি, তৃতীয় নামের শত্রু সম্পত্তি, অতি মূল্যায়িত সম্পত্তি, মামলার অধীনস্থ সম্পত্তিসহ নানা ধরনের ভেজাল সম্পত্তি দিয়ে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেওয়ার ঘটনা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। শোনা যায় ব্যাংক থেকে ভেজালি সম্পত্তির বিপরীতে ঋণ জোগাড় করে দেওয়ার জন্য প্রভাবশালী দালাল-কোম্পানি ইত্যাদি আছে। তাদের কাজই দুই নম্বরি সম্পত্তির ডকুমেন্ট তৈরি করে দেওয়া। এটা একটা ব্যবসা; বেশ বড় ব্যবসা। একশ্রেণির ব্যবসায়ী ওত পেতে থাকে কীভাবে দুই নম্বরি জামানত দিয়ে ব্যাংক থেকে ‘লোন’ নেওয়া যায় এবং ব্যাংকগুলোকে বিপদে ফেলা যায়। দিন দিন এ ধরনের বাজে লোকের সংখ্যা বাড়ছে। তারা দুই নম্বরি সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে ‘লোন’ নিচ্ছে, নেওয়ার জন্য সব সময় উদ্যোগ নিচ্ছে, প্রভাব খাটাচ্ছে। সাধারণভাবে দেখা যায়, যেসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত ‘সিকিউরিটি’ বা বন্ধকি সম্পত্তি বা মালামাল আছে সেসব ঋণ সাধারণত খেলাপি ঋণে পরিণত হয় না। যেসব ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি ‘কণ্টকাকীর্ণ’, সেই ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত আসে না বললেই চলে। কারণ বন্ধকির ওই সম্পদ নিয়ে  গ্রাহকরা আদৌ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয়। কারণ এই সম্পত্তি বিক্রি হলে তার কোনো ক্ষতি নেই। প্রথমত মামলা হবে। অল্প কিছু টাকা খরচ করলেই উচ্চতর আদালতে মামলার বিরুদ্ধে ‘রিট’ করা যাবে। উচ্চতর আদালতে গেলেই সাধারণভাবে ‘প্রটেকশন’ পান গ্রাহকরা।

ব্যাংকের টাকা আর ফেরত আসে না : অর্থ আত্মসাতে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম দুর্নীতি, ঋণ কেলেঙ্কারি, জালিয়াতির নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও অর্থ উদ্ধার হয় না। মামলায় গ্রেফতার, সাময়িক বরখাস্ত কিংবা দোষী কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হলেও ব্যাংকের লুটে নেওয়া টাকা আর ফেরত আসে না। আদালতের রায়ে আত্মসাৎ হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়া না গেলে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করারও নির্দেশ থাকে। অধিকাংশ মামলায় দেখা যায়, আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত না দিলে সাজা খাটতে হয় অপরাধী কর্মকর্তাকে। সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিজের নামে করা সম্পদ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায়, তা আত্মসাৎকৃত অর্থের তুলনায় খুবই নগণ্য। সে কারণে লোভী কর্মকর্তারা টাকা মেরে দিয়ে গ্রেফতার এবং নির্ধারিত কিছু দিন হাজতবাসের মধ্য দিয়ে রেহাই পেয়ে যান বললেই চলে। টাকা আত্মসাতের এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে, বরখাস্ত হয়েছে, জেল হয়েছে বা সাজা হয়েছে-কিন্তু টাকা পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মামলার সাক্ষী-সাবুদ না পাওয়ায় মামলাও খারিজ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশৃঙ্খলা ফেরাতে হলে অনিয়ম দেখাশোনার জন্য শক্তিশালী একটি কমিশন গঠন এবং অর্থঋণ আদালতকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। প্রয়োজনে আর্থিক অনিয়মের বিচারের জন্যও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এবং দ্রুত আপিল নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। ঋণ জালিয়াতি ও খেলাপিদের ফৌজদারি অপরাধীদের মতো আটক রাখার বিধান করে আইন প্রণয়ন করা হলে পরিস্থিতির উন্নয়ন হতে পারে বলেও মনে করেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর