মঙ্গলবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডাকসু ভোটে অনিয়ম হলে পরিণতি সুখকর হবে না

পীর হাবিবুর রহমান

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন দীর্ঘ ২৭ বছর পর হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে সব মহলে ব্যাপক আশার আলো জেগেছে। কৌতূহলেরও শেষ নেই। দীর্ঘদিন ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে নিরন্তর লিখেছি। টকশোয় কথা বলেছি। গণমাধ্যমসহ রাজনৈতিক মহলও ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। যে ডাকসু এ দেশে অসংখ্য রাজনীতিবিদ তৈরি করেছে, যে ডাকসু এ দেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধই করেনি, জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব তৈরির প্রোডাকশন হাউস হিসেবে কাজ করেছে, ‘৯০-উত্তর গণতন্ত্রের ২৭ বছর কী এক অদৃশ্য কারণে ক্ষমতাসীনরা যেমন ডাকসু নির্বাচনে আগ্রহ দেখাননি তেমনি ছাত্র সংগঠনগুলোও জোরালো দাবি তোলেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও উদাসীন থেকেছে। বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁড়িয়ে ডাকসুর তাগিদ দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন না হওয়ার কারণে রাজনীতিতে নেতৃত্বের বন্ধ্যত্ব তৈরি হয়েছে। ছাত্ররা ডাকসুর দাবিতে উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও জিএস ডা. মুশতাক হোসেন হাই কোর্টে রিট মামলা করেছেন। মহামান্য আদালত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়েছে। তবু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব থেকেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদার মনোভাব গ্রহণ করলে ঢাবি কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ১১ মার্চ ঘোষণা করে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনার দুয়ার খুলেছে। জাতির সামনে এই ডাকসু নির্বাচন আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে।

কয়েকদিন আগে কালের কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানাতে এসে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে বলেছিলেন, ২৭ বছর নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন হলে ৫৪ জন নেতা তৈরি হতেন। যেখান থেকে ১০ জন নেতা জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসতেন। এ দেশের ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগ ঐতিহ্যবাহী সেই ছাত্র সংগঠন যারা জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকাই পালন করেনি, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস।’ ছাত্রলীগের রাজনীতিই নয়, এ দেশের ছাত্র ও গণরাজনীতিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এক বিশাল মাইলফলক। সেই গণঅভ্যুত্থানের নায়ক হয়েছিলেন আজকের প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ। ডাকসুর ভিপি হিসেবে ’৬৯-এর গণআন্দোলনে তার সফল নেতৃত্বই তাকে নায়কের আসনে রাজনীতিতে অভিষিক্ত করেছিল। সেই গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের করুণ বিদায়ই ঘটেনি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু উপাধি নিয়ে সেনাশাসকদের ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত হয়ে এসেছিলেন। সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতি ও বাঙালির মহত্তম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জাতি ’৭০-এর গণরায় নিয়ে দেশকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলেই দেয়নি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করেছিল।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, সাবেক ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গিয়ে অপরাজেয় বাঙলার পাদদেশে দাঁড়িয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন- ছাত্রলীগ আবার ডাকসুতে বিজয়ী হবে। আওয়ামী লীগ টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি একচ্ছত্র করেছে। ’৯০-উত্তর গণতন্ত্রের এই ২৭ বছরে একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি তেমনি সব শিক্ষাঙ্গনে যখন যে দল ক্ষমতায় তাদের ছাত্র সংগঠন একচ্ছত্র দখলদারিত্ব যেমন প্রতিষ্ঠা করেছে তেমনি সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোণঠাসাই হননি, সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে বাধাগ্রস্তই হননি, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িতও হয়েছেন। বিএনপি জমানায় যেমন ছাত্রলীগ হয়েছে তেমনি আওয়ামী লীগ জমানায় ছাত্রদল হয়েছে। এ দেশের ছাত্রসমাজ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বরাবর ক্যাম্পাসে অপ্রতিরোধ্য ঐক্য গড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরকে রাজনীতির অধিকার দেয়নি। ডাকসুতে নির্বাচন করার সুযোগও নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ক্যাম্পাস ও হল নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবারিত রেখেছে। দীর্ঘ ২৭ বছর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণে ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্যের ধারা হোঁচট খেয়েছে। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি নির্বাসিত হওয়ার কারণে গণরাজনীতিতে আদর্শিক মেধাবী সংগঠকদের বা নেতৃত্বের অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ হয়েছে।

এবার ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন আবার নিয়মিত শুরু হলে ছাত্র রাজনীতির প্রতি মেধাবী তারুণ্যের আকর্ষণ ও অংশগ্রহণ যেমন ঘটবে তেমনি ছাত্র রাজনীতি তার ঐতিহ্যের সুস্থ ধারায় প্রত্যাবর্তন করবে, তেমনি শিক্ষাঙ্গনগুলোতে লেখাপড়ার পরিবেশ যেমন সুন্দর হয়ে উঠবে তেমনি মুক্তচিন্তার জায়গাটি প্রসারিত হবে। ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য দাবিদাওয়া যেমন পূরণ হবে তেমনি লেখাপড়ার বাইরে তাদের সৃজনশীল কর্মকাে র বিকাশ ঘটবে। শিক্ষাঙ্গনে বিতর্ক, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, নাটক ও খেলাধুলার চর্চা নিয়মিত হবে। আমাদের তারুণ্য আবার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন তৈরি হবে তেমনি সমাজের নানা শ্রেণি-পেশায় রাজনৈতিক সচেতন মেধাবী নেতৃত্বের আগমন ঘটবে। ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলো নানা দাবিদাওয়া নিয়ে দরকষাকষি করছে। সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষ যেমন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ, তারিখ নির্ধারণ করবে তেমনি নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা তাদের বড় দায়িত্ব। সব ছাত্র সংগঠনের ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের পাশাপাশি নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের জন্য ক্যাম্পাস নিরাপদ জায়গায় পরিণত করতে হবে। বহিরাগতদের বের করে আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা যে সংগঠনেরই হোক তাদের হলে হলে অবস্থান নিশ্চিত করে নিরাপত্তা দিতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন বা ভোটযুদ্ধ উৎসবমুখর পরিবেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলতে হলে সব ছাত্র সংগঠনকে প্রচার-প্রচারণার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ১১ মার্চ ঘোষণা করেছে। এখনই ক্যাম্পাসে নির্বাচনের অবাধ আনন্দঘন নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার কাজ শুরু করে দিতে হবে। বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল বিজয় অর্জন করলেও নির্বাচন নিয়ে পরাজিত পক্ষ প্রশ্নই তোলেনি, ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। ১১ মার্চের নির্বাচনে ছাত্রদল এককভাবেই ভোট করুক আর বামপন্থিরা মিলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেলে দিক তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হবে ছাত্রলীগ- এটি নিশ্চিত বলা যায়। টানা ১০ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ছাত্রলীগ শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। যত শক্তিশালী হোক না কেন, ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অতীতের ঐতিহ্যের পথে সব প্রশ্ন বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে দেশবাসীর সামনে গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পন্ন করতে হবে। ফলাফল যাই হোক, মেনে নিতে হবে। এমনকি শাসক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও যদি পরাজিত হয় তাদের সেই ফলাফল মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে তাদের যেমন অংশগ্রহণ করতে হবে তেমনি শাসক দলকেও সেই মনোভাব পোষণ করতে হবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম হলে তার পরিণতি সরকারের জন্যই সুখকর হবে না। অনিয়ম হলে তারুণ্যের দ্রোহ প্রতিবাদের আগুনে বিস্ফোরিত হবে। সেনাশাসকদের জমানায়ও যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম হয়নি সেখানে সেকেন্ড পার্লামেন্ট খ্যাত ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলে অনিয়ম হতে পারে না। আইয়ুবের আমলে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাও একটি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে বিজয়ী হয়েছিলেন। চারবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও সেই অর্জন তার জন্য কম গৌরবের নয়। দেশবাসীর প্রত্যাশা- এ দেশের ছাত্রসমাজ বা তারুণ্যের শক্তিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চায় বা অনুশীলনে প্রকৃত রাজনীতিবিদ হিসেবে তৈরি করতে হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে সম্পন্ন করা সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে আশার আলো নতুন দুয়ার খুলে দিক- এটি আমাদের প্রত্যাশা। সরকারসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য ২৭ বছর পর ডাকসু নির্বাচন যেমন চ্যালেঞ্জের তেমনি দেশবাসীর জন্য বিপুল প্রত্যাশার।

সর্বশেষ খবর