শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

আমার আম্মা জাহানারা ইমাম

ইমদাদুল হক মিলন

আমার আম্মা জাহানারা ইমাম

রোববার পত্রিকায় কাজ করার সময় জাহানারা ইমামকে প্রথম দেখি। আটাত্তরের শেষ কিংবা উনআশির গোড়ার দিককার কথা। জাহানারা ইমাম প্রায়ই রোববার অফিসে আসতেন। রাহাত খান, রফিক আজাদ, এঁদের সঙ্গে তাঁর খুব অন্তরঙ্গতা ছিল। রোববার পত্রিকাটি বেরোবার চার-পাঁচ মাস আগে থেকে নিয়মিত অফিস করতে শুরু করেছিলাম আমরা। ডিক্লারেশন পেতে দেরি হচ্ছিল বলে কাগজ বেরোচ্ছিল না। অফিসে নিয়মিত আড্ডা হতো। সেই আড্ডায় কখনো কখনো আসতেন জাহানারা ইমাম। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করতেন, অত্যন্ত স্মার্ট এবং প্রাণবন্ত মহিলা। মুখে সারাক্ষণই লেগে আছে মধুর একখানা হাসি। এসবের কিছুকাল পর জেনেছি জাহানারা ইমামের মধুর হাসিমাখা মুখখানির আড়ালে চাপা পড়ে আছে গভীর এক বেদনাবোধ। সেই বেদনা স্বজন হারানোর। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম তাঁর স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে, সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা রুমীর মা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মা। রফিক আজাদ, শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির এবং আমার প্রিয়বন্ধু শিল্পী কাজী হাসান হাবিব- এঁরা সবাই জাহানারা ইমামকে আম্মা ডাকতেন। আমিও তাঁকে আম্মা ডাকতে শুরু করেছিলাম। আমার বন্ধু হাবিবকে কেড়ে নিয়েছে ক্যান্সার। আমার আম্মাকেও কেড়ে নিয়েছে ক্যান্সার। মনে আছে রোববার প্রথম সংখ্যা বেরোবার পর দুটো কাগজ হাতে নিয়ে  আমি তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে গিয়েছি। তিনি যে কী খুশি হয়েছিলেন! বললেন, কাগজ তিনি আগেই দেখেছেন। আমার দুটো লেখা ছিল প্রথম সংখ্যা রোববারে। একটি গল্প, আরেকটি প্রায় গল্পের মতো করে লেখা সাহিত্য সংবাদ। সেবার জামালপুরে একটি সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। রফিক আজাদের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম সেই সম্মেলনে। আমাদের কিছু ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার কথা লিখেছিলাম ওই লেখায়। আম্মা বললেন, লেখাটা তিনি আগেই পড়ে ফেলেছেন। আমার গদ্যভাষার প্রশংসা করলেন। রোববারের কোনো এক সংখ্যায় গল্প লিখলাম ‘মানুষ কাঁদছে’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গল্প। আম্মা দুর্দান্ত প্রশংসা করলেন। তিনি নিজে একজন বড় মাপের লেখক, বড় লেখকরা সাধারণত  নতুনদের লেখার প্রশংসা করেন না, আম্মার প্রশংসা আমাকে অভিভূত করেছিল। আমার ভেতরটা সম্পূর্ণতই দখল করে নিলেন তিনি। বরিশাল থেকে আমার দুই বন্ধু এলো। কী এক অনুষ্ঠানে ষাটজন ছেলেমেয়েকে পুরস্কৃত করবে। আমি বললাম, ‘একাত্তরের দিনগুলি’ হচ্ছে আদর্শ বই। ওরা ষাট কপি বই কিনল। আমাকে বলল, প্রতিটি বইয়ে আম্মার শুভেচ্ছাবাণী লিখে আনতে। ষাটখানা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এবং দুই বন্ধুকে নিয়ে আম্মার বাড়িতে গিয়েছিলাম। পথ থেকে কিনে নিয়েছিলাম টকটকে কিছু লাল গোলাপ। সেই ফুল যখন হাতে দিয়েছি গভীর আবেগে চোখ ছলছল করে উঠেছিল তাঁর। দুহাতে অনেকক্ষণ আমাকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। আমার মা ছাড়া অন্য কোনো মা কখনো এভাবে আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেননি। দিন গিয়েছে এইভাবে।

ঘাতক দালাল নিমর্ূূল কমিটি হলো। আম্মা হলেন সেই কমিটির প্রধান। ঐতিহাসিক সব পদক্ষেপ নিলেন, জয় করলেন স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি মানুষের মন। এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তিনি, দেখা-সাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল আমাদের। তবু এক কাগজের সাক্ষাৎকারে দেখি লেখালেখি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি আর কী লিখব বলুন! সবই তো মিলন লিখে ফেলছে।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলেন ঢাকায়। আমরা দুজন গিয়েছি আম্মার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি যতটা প্রশংসা করলেন সুনীলের লেখার, ততটাই করলেন আমার লেখার। একজন মানুষ নিজে কত বড় হলে সুনীলের মতো একজন বিশাল মাপের লেখকের পাশাপাশি আমার মতো একজন নগণ্য লেখকের প্রশংসা করতে পারেন ভেবে আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ উপন্যাসের অনেকখানি জুড়ে আছেন আম্মা। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বটি আম্মাকে উৎসর্গ করা। আম্মা নিজে অনেক বড় মাপের লেখক। সেই ছেলেবেলায় তাঁর অনুবাদে পড়েছিলাম লরা এঙ্গেলস ওয়াইলডারের ‘লিটল হাউস অনদা প্রেইরি’র একটা পর্ব। সেই পর্বের নাম ছিল ‘নদীতীরে ফুলের মেলা’। কী অপূর্ব ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন! বিচিত্রায় উপন্যাস লিখেছিলেন ‘নিঃসঙ্গ পাইন’। আত্মজীবনীর অংশ হিসেবে লিখলেন ‘ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস’। আর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল নিয়ে লেখা তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ শুধু বাংলাভাষারই নয়, এই পৃথিবীরই একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন। তখন থেকেই পড়তাম। বই হয়ে বেরুবার পর কতবার যে পড়েছি! এই বইটির কোনো তুলনা নেই। এরকম একটি বইয়ের জন্যই একজন লেখক অমর হয়ে যেতে পারেন। জাহানারা ইমাম অমর লেখক।  আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলাম বিরানব্বই সালে। তার কয়েকদিন পর আম্মার সঙ্গে দেখা হলো। বইমেলার ওই ভিড়ের মধ্যে আমাকে বুকে জড়িয়ে তিনি বললেন, আমার দোয়া না থাকলে কি এতবড় একটা পুরস্কার তুই পেতি?

আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আম্মাকে নিয়ে এসবই আমার স্মৃতি, আমার মূল্যবান সম্পদ। তাঁর সঙ্গে আমার দু-একটি ছবি আছে। সেই সব ছবি কোনো ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখিনি। এত বড় একজন মানুষকে কোনো ফ্রেমে আটকে রাখা যায় না। তাঁর মতো মানুষ থাকেন মানুষের মনের সবখানি জায়গা জুড়ে। আমার শুধু মনজুড়ে নেই তিনি, চোখজুড়েও আছেন। চোখ খোলা রেখে, চোখ বন্ধ করে আমি তাঁর মধুর হাসিমাখা মুখখানি দেখতে পাই। এরকম মুখ জাহানারা ইমাম ছাড়া আর কার হতে পারে! এরকম মুখ আমার আম্মা ছাড়া আর কার হতে পারে!

সর্বশেষ খবর