শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
নিরাপদ খাদ্য দিবস আজ

খাবার মানেই বিষ আতঙ্ক

হোটেল-রেস্তোরাঁ ফাস্টফুডের খাবার নিয়ে উৎকণ্ঠা

সাঈদুর রহমান রিমন

খাবার মানেই বিষ আতঙ্ক

খাবার মানেই বিষ আতঙ্ক! বেঁচে থাকার প্রধান মৌলিক চাহিদা ‘খাদ্য’ খেতে বসলেই মনে প্রশ্ন জাগে কী খাচ্ছি- খাবারের নামে ভেজালের বিষ নয় তো? কি বাড়িতে, কি বাইরে; হোটেল-রেস্তোরাঁ, ক্যান্টিন কিংবা ক্লাব-মেসের নিজস্ব খাবার ব্যবস্থাপনা- সর্বত্রই অভিন্ন অরুচিকর পরিস্থিতি। জীবনযাত্রার সব স্থানে খাবারই হয়ে উঠেছে প্রধান আতঙ্ক। এমন সন্দেহ, প্রশ্ন আর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেই চলছে খাওয়া-দাওয়া। ইতিমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ভেজালবিরোধী অভিযান শুরু করলেও তা সমন্বয়হীনতায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারছে না। ভোক্তাদের অভিযোগ, প্রতি বছর রমজান মাস এলেই বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, ডিসিসিসহ বিভিন্ন সংস্থা হোটেল-রেস্তোরাঁ, ইফতারি বিক্রেতাদের দোকানে দোকানে অভিযান চালাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সেসব অভিযান-জরিমানার জাল কেবল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণির হোটেল-রেস্তোরাঁর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠিত হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের কথিত অভিজাত দোকানে অভিযানের আঁচ পড়ে না বললেই চলে। অতি সম্প্রতি অভিজাত শ্রেণির হোটেল-রেস্তোরাঁয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাতেই নানা ঘৃণ্যচিত্র বেরিয়ে আসে। ভেজালবিরোধী অভিযানে জরিমানাসহ কারাদণ্ডাদেশ দেওয়ার পরও হোটেলগুলোয় মরা মুরগির বাণিজ্য অব্যাহত থাকছে। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রায় দেড় মণ মরা মুরগির মাংসসহ দুই মাংস বিক্রেতাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। এরপর তাদের দেওয়া তথ্যমতে মরা মুরগির মাংস ক্রেতা হোটেল-রেস্টুরেন্টসমূহে অভিযান চালিয়ে সেসব তথ্যের সত্যতাও পায়। পরে হোটেলগুলোকে তিন লাখ টাকা করে জরিমানা ধার্যসহ অভিযুক্তদের তিন মাস করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এর আগে ধানমন্ডির একটি স্বনামধন্য রেস্টুরেন্ট থেকেও ৩০০ পিস মরা-পচা মুরগিসহ হাতেনাতে দুজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। একই অভিযোগ মাথায় নিয়ে ধানমন্ডির নামিদামি রেস্টুরেন্টটি এখনো রমরমা বাণিজ্য চালাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রমতে, গ্রিল ও শর্মায় সয়লাব রাজধানীর ফাস্টফুড, হোটেল ও রেস্টুরেন্টে অনেক ক্ষেত্রেই মরা মুরগি অহরহ ব্যবহার হচ্ছে। একইভাবে কেক, জেলি ও সসে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম গন্ধ, রাসায়নিক পদার্থ ও বিষাক্ত রং। ভোক্তাদের আকর্ষণ করতে বেশির ভাগ এনার্জি ড্রিংকে ব্যবহার হচ্ছে ক্যাফেইন ও উত্তেজক পদার্থ সিলডেনাফিল সাইট্রেট। বাজারে এখন কাঁচা রাবারে তৈরি ডিমের বেচাকেনাও চলছে জোরেশোরে। বিভিন্ন বার্গার পণ্যে এসব ডিমের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। রাজধানীর সবুজবাগের মান্ডা, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, লালবাগের যত্রতত্র গড়ে উঠেছে বেকারি। কালি-ঝুলি মাখা বেকারি পণ্য কারখানার ভিতরে-বাইরে কাদাপানি, তরল ময়লা, আবর্জনাযুক্ত নোংরা পরিবেশ। দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। আশপাশেই নর্দমা, ময়লার স্তূপ; মশা, মাছির ভনভন আর একাধিক কাঁচা-পাকা টয়লেটের অবস্থান। কারখানাগুলো স্থাপিত হয়েছে টিনশেড ভবনে। বহু পুরনো চালার টিনগুলো স্থানে স্থানে ছিদ্র থাকায় বৃষ্টির পানি অনায়াসেই ঢোকে কারখানা ঘরে। এতে পিচ্ছিল কর্দমাক্ত হয়ে থাকে মেঝে, কাদাপানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় খাদ্যে। খাবারেই জটিল কঠিন ১৫ রোগ : খাদ্যপণ্যে বেশুমার ভেজালের পরিণতিতে শরীরে বাসা বাঁধছে জটিল রোগবালাই; অকালমৃত্যু পর্যন্তও ঘটছে। এ ছাড়া মায়ের গর্ভেই বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম নেওয়া, অন্ধত্ব, ক্যান্সার, হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভারের জটিলতাসহ ১৫টি কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ভেজাল খাদ্যভোগী মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানাভাবে খাদ্যে ভেজাল বা বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রবেশ ঘটে। সামান্য কিছুটা প্রাকৃতিকভাবে হলেও বেশির ভাগই অসচেতন কৃষক আর স্বার্থান্বেষী, অতিমুনাফালোভী, অসাধু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই খাদ্যপণ্যে বিষ ঢুকছে। আর এসব খাবার আমরা নির্বিঘ্নে গিলছি। যদিও বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায় এমন খাবারের মধ্যে কয়টাতে বিষ নেই তা হয়তো আঙ্গুলে গোনা যাবে। যেখানে উন্নত রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় ভেজালমুক্ত খাবারের ওপর। যাদের ব্যর্থতায় আতঙ্কের জীবন : হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফুটপাথ দোকানের খাবারের মান নিয়ন্ত্রণসহ তা স্বাস্থ্যসম্মত কিনা নির্ণয় করার মূল দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) হলেও প্রতিষ্ঠানটি লোকবল সংকটের কথা উল্লেখ করে বরাবরই দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। বিএসটিআই ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও কিছুটা তৎপর থাকলেও খোদ রাজধানীতেই তাদের অভিযান ঝিমিয়ে থাকছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে ভেজাল খাদ্যপণ্য শনাক্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১৭টি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই)। বিএসটিআই আইন-২০১৩ (সংশোধিত) অনুযায়ী খাদ্যের মান বিএসটিআই দ্বারা প্রত্যায়িত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু নিরাপদ খাদ্যমান নিশ্চিত করতে বিএসটিআইর নজরদারি ক্রমান্বয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হলো স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকা সিটি করপোরেশন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্য অধিদফতর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, পরিবেশ দূষণ মনিটরিংয়ের জন্য পরিবেশ অধিদফতর ও পরীক্ষাগার, মাছে রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রণ শনাক্তে মৎস্য অধিদফতর, পশুরোগ পরীক্ষা এবং পোলট্রি ফিড নিয়ন্ত্রণের জন্য পশুসম্পদ বিভাগ, কৃষিপণ্যের গুণাগুণ দেখার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং এবং পানির গুণগত মান মনিটরিংয়ের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর। রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ঢাকা সিটি করপোরেশন স্বাস্থ্য বিভাগের বড় একটি ভূমিকা থাকার কথা। কিন্তু ভুক্তভোগী নাগরিকরা সংস্থাটির কোনো তৎপরতা চোখে দেখতে পান না বললেই চলে। প্রশংসনীয় গ্রেডিংব্যবস্থাও সীমাবদ্ধ : বিলম্বে হলেও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে দেশে গত ২১ জানুয়ারি চালু হয়েছে রেস্তোরাঁর গ্রেডিংব্যবস্থা। প্রাথমিকভাবে কেবল ঢাকার ৫৭টি রেস্তোরাঁকে এ ব্যবস্থায় গ্রেডিং বা মান অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এসব হোটেল-রেস্তোরাঁর মান অনুসারে কয়েকটি রঙের স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছে। এ প্লাসকে সবুজ, এ গ্রেডকে নীল, বি গ্রেডকে হলুদ ও সি গ্রেডকে কমলা রঙের স্টিকারে ভোক্তাদের কাছে পরিচিত করে দেওয়ার উদ্যোগ রয়েছে। সবুজ স্টিকার মানে উত্তম, নীল মানে ভালো, হলুদ মানে গড়পড়তা বা মোটামুটি এবং কমলা স্টিকার মানে অনিরাপদ ঝুঁকিপূর্ণ খাবারের রেস্টুরেন্ট হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি একটি আন্তর্জাতিক মানসম্মত গ্রেডিং পদ্ধতি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। রেস্তোরাঁ মালিকরা বার বার মোবাইল কোর্ট কার্যক্রমে জরিমানা দেওয়ার ফলে আমাদের কাছে স্থায়ী সমাধান চেয়েছেন। আমরা তাদের জন্য এই সিস্টেম এনেছি। এতে রেস্তোরাঁ মালিকরাও খুশি হয়েছেন।’ ভবিষ্যতে দেশব্যাপী রেস্তোরাঁগুলোকে এই গ্রেডিংয়ের আওতায় আনা হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। খাদ্যের বিষ থেকে বাঁচাতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রশংসনীয় উদ্যোগটি এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট বৃত্তেই আটকে রয়েছে। পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকার ৫৭টি হোটেল এ ব্যবস্থার আওতায় নেওয়া গেলেও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার কোনো ব্যবস্থাপনা চোখে পড়ছে না।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর