সোমবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিএনপির ঢাউস কমিটির কাজ কী

নির্বাহী কমিটির সদস্য ৫০২ উপদেষ্টা ৭৮। ভোটের পর মানববন্ধনে ছিলেন না ৫০০ নেতা-কর্মীও

মাহমুদ আজহার

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদকে ‘ভুয়া’ দাবি করে তা বাতিলের দাবিতে গত বুধবার মানববন্ধন করে বিএনপি। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ফুটপাথে এক ঘণ্টার মানববন্ধনে ৫০০ নেতা-কর্মীও অংশ নেননি। সেদিনের কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা বা কাউকে গ্রেফতারও করেনি। প্রেস ক্লাবের সামনে বাম বা অন্যান্য ছোট ছোট সংগঠনের মানববন্ধনের সঙ্গেও তুলনা করেন ওই কর্মসূচিতে আসা বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ। এই দলের ঢাউস কমিটির কাজ কী-এমন প্রশ্নও তোলেন কোনো কোনো নেতা। জানা যায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ৫০২ জন। ১১টি অঙ্গ সংগঠনের নেতার সংখ্যাও সহস্রাধিক ছাড়াবে। ২৯৮টি সংসদীয় আসনে ধানের শীষের প্রার্থীও ছিলেন। নির্বাচনে অনিয়ম ও সংসদ বাতিলের দাবিতে তাদেরও থাকার কথা ছিল। কিন্তু হতাশায় আচ্ছন্ন থাকা বিএনপির প্রার্থীদের কাউকেই দেখা যায়নি ওই কর্মসূচিতে। অনেকেই অবশ্য মামলা-গ্রেফতারের ভয়ে সমাবেশে যোগদান করেননি বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়। কর্মসূচিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান ছাড়া বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের মাত্র ২০ জন নেতা অংশ নেন। অথচ বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্যের সংখ্যা ১৯ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৩৫ জন, উপদেষ্টা পরিষদে ৭৮ জন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবসহ যুগ্ম মহাসচিব ৭ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ১০ জনসহ বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে রয়েছেন ১৬১ জন কর্মকর্তা। বাকি ২৮২ জনের সবাই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। ওই কর্মসূচিতে তারা অংশ নিলে বিশাল সমাবেশ হয়ে যেত। কর্মসূচিতে যোগদান না করা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কেবলমাত্র নির্বাচন শেষ হয়েছে। অনেকেই এলাকায় নেতা-কর্মীদের মামলা নিয়ে ব্যস্ত। আর ঢাকায় যারা রয়েছেন, সবাই হয়তো কর্মসূচি সম্পর্কে জানেনই না। গ্রেফতার আতঙ্ক তো ছিলই। সব মিলিয়ে নেতা-কর্মীর সংখ্যা তুলনামূলক কম হয়েছে।

তবে ভিন্ন কথা বলছেন বিএনপি সমর্থিত বুদ্ধিজীবী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তার মতে, ‘মনোনীত কমিটি হওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। যদি বিএনপির সব কমিটি নির্বাচিত থাকত, তারা ওই কর্মসূচিতে যেতেন। কারণ, দলের নেতা-কর্মীদের কাছে তাদের জবাবদিহিতা থাকত। ভবিষ্যতেও তাদের আবার নেতা নির্বাচিত হতে হবে সেই সম্ভাবনা থেকেই সব কর্মসূচিতে নেতারা কর্মীদের নিয়ে সমাবেশে যেতেন। তিনি বলেন, মনোনীতরা হালুয়া রুটির ভাগ ছাড়া কোথাও যাবেন না। কারণ, তারা নানা সুবিধার বিনিময়ে কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন। তার মতে, ‘অবিলম্বে বিএনপির সব কমিটি ভেঙে দেওয়া উচিত। নির্বাচিত কমিটি করতে একটি কাউন্সিল ডাকা জরুরি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সব কমিটিই হতে হবে নির্বাচিত। তাহলেই যে কোনো কর্মসূচি সফল করতে পারবে দলটি।’ রাজধানীতে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে মাঝে-মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল বের করে বিএনপি। কিন্তু সেখানেও ১০০ নেতা-কর্মীর দেখা মেলে না। অঙ্গ সংগঠনের নেতাদেরও মাঝে মঝে ঝটিকা মিছিল করতে দেখা যায়। ওইসব মিছিল দুই-চার মিনিট স্থায়ী হলেও নেতা-কর্মীর সংখ্যা থাকে খুবই নগণ্য। এ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরেও হয় নানামুখী সমালোচনা। রাজনৈতিক সমালোচকরা বলছেন, দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে বিএনপির নির্বাহী কমিটিসহ অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা যদি মাঠে নামেন তাহলেও বিশাল মিছিল বের করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ নেতাই পদ নিয়ে লাপাত্তা। মামলা বা গ্রেফতারের অজুহাত দেখিয়ে কর্মসূচিতে আসতে চান না। অথচ কমিটিতে পদ নেওয়ার সময় সবাই বলেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মাঠে থাকবেন। সূত্রমতে, বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে সক্রিয় গুটি কয়েকজন। ভাইস চেয়ারম্যান পদেও হাতেগোনা কয়েকজনকে মাঠে দেখা যায়। ৭৮ সদস্যের উপদেষ্টাদের অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়। যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক, সহ-সাংগঠনিক ও দফতর, সহ-দফতর ও প্রচার শাখার নেতারা বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে থাকেন। এ ছাড়া অন্যান্য সম্পাদকীয় পর্যায়ের নেতা ও নির্বাহী কমিটির সদস্যদের বড় অংশই নিষ্ক্রিয়। ঢাকা মহানগর বিএনপি ছাড়াও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ কয়েক নেতা সক্রিয় থাকলেও অধিকাংশই পদ নিয়ে ছিটকে পড়েছেন।  জানা যায়, বিশাল কমিটিতে বিভিন্ন পদও সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা নির্দিষ্ট পদে কোনো কাজ করেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, বিশেষ সম্পাদক, আন্তর্জাতিক-সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছাড়াও কোষাধ্যক্ষ, মুক্তিযোদ্ধা, আইন, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ, কর্মসংস্থান, যুব, স্থানীয় সরকার, শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক,  ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গবেষণা, তথ্য, জলবায়ু, ব্যাংকিং-রাজস্ব, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, মহিলা, প্রশিক্ষণ, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষি, স্বেচ্ছাসেবক, গণশিক্ষা, ধর্ম, প্রান্তিক জনশক্তি উন্নয়ন, বন ও পরিবেশ, স্বাস্থ্য, পরিবারকল্যাণ, সমবায়, পল্লী উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, গ্রাম সরকার, প্রকাশনা, স্বনির্ভর, তাঁতী, শিশু, প্রবাসীকল্যাণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি, মানবাধিকার, ক্ষুদ্র ঋণ, উপজাতি, মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদকের পদ সৃষ্টি করা হয়। অধিকাংশ পদের নেতারাই জানেন না নিজের কাজ কী? কমিটি ঘোষণার তিন বছরে ওই পদে কেউ কোনো কাজও করেননি। আবার দলীয় কর্মসূচিতেও আসেন না তারা। এ নিয়ে দলের পক্ষ থেকে কোনো জবাবদিহিতাও করা হয় না। বিএনপির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফর রহমান কাজল। গত তিন বছরেও মৎস্যজীবীদের নিয়ে কোনো সভা-সমাবেশ বা সেমিনার করা হয়ে ওঠেনি তার। তবে দলীয় সব কর্মকাে ই সক্রিয় ছিলেন তিনি। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি জানালেন, নেতা-কর্মীরা সবাই মামলা হামলায় জর্জরিত হয়ে আছে। সারা বছরই পুলিশি হয়রানিতে থাকতে হয়। তারপরও আমরা সারা দেশের মৎস্যজীবীদের নিয়ে এখন কাজ করব। কেন্দ্রীয় তিন সদস্যের কমিটি। এটাও পূর্ণাঙ্গ করা হবে।  বিএনপির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। এ বিষয় নিয়েও তিনি কোনো কাজ করার সুযোগ পাননি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, ‘যেভাবে গুম, খুন, গ্রেফতার হয়রানি হচ্ছে তাতে রাজনীতি করাই দায়। তারপরও আমি সামনে পরিবেশ ও বন নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করব।’

সর্বশেষ খবর