মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
দুদকের তদন্ত কমিটি

মুক্ত হয়ে বিচার চাইলেন জাহালম

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় তিন বছর ধরে কারাগারে থাকা ভুল আসামি টাঙ্গাইলের জাহালম মুক্তি পেয়েছেন। মুক্তির পর এই জঘন্য ভুলের জন্য দায়ীদের কঠোর বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন জাহালম। তার এ অবস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুদকের বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন তিনি। এদিকে বিনা অপরাধে জাহালমের তিন বছর কারাভোগের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ কথা জানান। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, জাহালমের ঘটনায় দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের যদি কোনো গাফিলতি থেকে থাকে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা জজ পদমর্যাদার দুদকের একজন পরিচালককে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু দুদকের ভুলে সালেকের বদলে তিন বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছে টাঙ্গাইলের জাহালমকে। এদিকে হাই কোর্টের আদেশের পর রবিবার রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হলে তার ভাই শাহনুরকে সঙ্গে নিয়ে রাতেই গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবুরিয়ায় পৌঁছান জাহালম।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে জাহালমের বাড়িতে গতকাল সকাল থেকেই মানুষের ঢল নামে। গ্রামের লোকজন ছাড়াও আশপাশের এলাকার মানুষ ভিড় জমান জাহালমকে একনজর দেখতে। পেশায় একজন পাটকল শ্রমিক জাহালম দুদকের দায়ের করা মামলায় ভুল আসামি হলেও তিন বছর কারাগারে ছিলেন।

সকালে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবুরিয়া গ্রামে জাহালমের বাড়িতে আনন্দের যেমন কমতি দেখা যায়নি, তেমনি ছিল অন্য রকম এক আবেগঘন পরিবেশ। স্ত্রী আর একমাত্র কন্যাসন্তান ছাড়াও স্বজনরা জাহালমকে জড়িয়ে ধরে তাদের আবেগ আর আনন্দ প্রকাশ করে। এই জঘন্য ভুলের কঠোর বিচার এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তার স্বজনরা। জাহালমের ভাই শাহানুর বলেন, ‘আমরা এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছি। তারা যদি সঠিক ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আইনজীবীর মাধ্যমে আমরাই আইনি ব্যবস্থা নেব।’

ধুবুরিয়া গ্রামের বাবুল সরকার জানান, জাহালম একজন সরল প্রকৃতির মানুষ। এই পরিবারটি খুবই নিরীহ। জাহালমের মা একসময় অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। জাহালম বলেন, ‘দুদক যেন সঠিক তদন্ত করে সঠিক অপরাধীকে ধরে। ভুল আসামি হয়ে আমার মতো কাউকে যেন জেল খাটতে না হয়।’ জাহালম কারাগারে তিন বছরের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘সেখানে আমার খুবই কষ্টে দিন কাটাতে হয়েছে। কারণ আমার পরিবারের অবস্থা ভালো না। আমি কারাগারে সেবকের কাজ করতাম। একটু ভালো খাবারের জন্য ওয়ার্ডের ৪০ জন আসামির খাবার সরবরাহ এবং তাদের কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে অনেক কিছু করতে হয়েছে আমাকে। বিনা অপরাধে জেল খাটছি এটা ভেবেই আমার বেশি কষ্ট হয়েছে। আমি যদি অপরাধী হতাম, যদি এ ব্যাপারে কিছু জানতাম, তাহলে এত কষ্ট হতো না।’ তার এ অবস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুদকের বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন জাহালম। গত রাতে মুক্তির পর জাহালম তার ভাই শাহানুর মিয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কারাগার থেকে ভাই শাহানুরের সঙ্গে ভোররাত ৪টায় গ্রামের বাড়িতে আসেন জাহালম। জাহালমকে দেখে জড়িয়ে ধরে মা মনোয়ারা বেগম কাঁদতে থাকেন। রাতে জাহালমকে দুধ দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে তোলা হয়। সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২০১২ সালে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু ভুলে আবু সালেকের পরিবর্তে দুদকের চিঠি যায় জাহালমের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ধুবুরিয়ায়। চিঠি পেয়ে জাহালম দুদক কার্যালয়ে গিয়ে ঘটনার প্রতিবাদ করেন এবং জানান, তিনি সালেক নন। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে তার কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। গত বছর জাহালমের ভাই শাহানুর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে জাহালম বিনা অপরাধে জেল হাজতে রয়েছেন বলে জানান। পরে অনুসন্ধানে নামে মানবাধিকার কমিশন। গত বছর ২২ এপ্রিল কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন। এ কথা আদালতকেও জানায় কমিশন। অবশেষে রবিবার কারাগার থেকে মুক্ত হন জাহালম।

সর্বশেষ খবর