বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঋণ বাড়ছে ভুয়া দলিলে

মর্টগেজকৃত জমিজমা, ভবনে ব্যাংকের দায়বদ্ধতার সাইনবোর্ড বাধ্যতামূলক হলেও কেউ মানে না তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভুল দলিল আর কাগজপত্র মর্টগেজ রেখে ঋণ দিয়ে বিপাকে পড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক। এসব ঋণের বিপরীতে দেওয়া মর্টগেজের কাগজপত্র ভুয়া প্রমাণিত হচ্ছে। ফলে ঋণ দেওয়ার পর সম্পত্তি, ভবন বা জমিজমার সামনে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ এমন সাইনবোর্ড সাঁটানোর সময় প্রকৃত মালিক কিংবা মালিকানার দ্বন্দ্বের কাছে হেরে যাচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ফলে ওইসব ঋণ পরবর্তীতে অনাদায়ী থাকছে দিনের পর দিন। ব্যাংকের কাছে জমা দেওয়া নাম-ঠিকানা অনুযায়ী ঋণগ্রহীতার অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না এমন ঘটনাও ঘটছে ব্যাংকিং খাতে। এ নিয়ে ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে বাড়ছে অবিশ্বাস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকের কাছে মর্টগেজকৃত জমিজমা, ভবন বা সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধতা রয়েছে এমন সাইনবোর্ড দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও সঠিকভাবে পরিপালন করছে ব্যাংকগুলো। ফলে এ বিষয়ে জালিয়াতির মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো ধরনের ঋণ দেওয়ার আগে প্রস্তাবগুলো অধিক যাচাই-বাছাই করা জরুরি। এ ছাড়া এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে একশ্রেণির ব্যাংক ও ব্যাংক মালিকদেরই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়েও খতিয়ে দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ তদারকি বিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিও আরও বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। তিনি বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকগুলো একটু নড়েচড়ে বসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত চার দশকে এভাবে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকা। এ ছাড়া প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংকেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা জানাজানি হওয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অবিশ্বাস। লেনদেনের সম্পর্কে ধরছে ফাটল। ফলে বিপাকে পড়েছেন প্রকৃত উদ্যোক্তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ঘটনার জের ধরে প্রকৃত ঋণগ্রহীতা বা উদ্যোক্তাদের প্রতারক সন্দেহের তালিকায়ও রাখছে ব্যাংকগুলো। এ ধরনের ঘটনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে না পারলে শিগগিরই ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। সূত্র জানায়, এই প্রতারক চক্র কখনো কখনো ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে যায়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশেও ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে বন্ধকি সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে, ভুয়া এলসি খুলে কিংবা জাল সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর বন্ধক রাখার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণখেলাপি সৃষ্টি হয়েছে। ভুয়া দলিল, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করছে না গ্রাহক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংককে দেওয়া কাগজপত্ররে ঠিকানা অনুযায়ী গ্রাহকের খোঁজ পায় না ব্যাংক। খোঁজ পেলেও আইনি জটিলতায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করলেও তা ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। কিন্তু এর কোনো সমাধান হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে পাঁচ বছর পর ওইসব ঋণ মন্দ ঋণে পরিণত করছে। ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।

জানা গেছে, ২০০৩ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নিয়ম চালু হওয়ার সময় ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকিং খাতে মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা। আর বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। সূত্র জানায়, ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনার ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানতে পারার পর সুনাম ক্ষুণœ হওয়ার ভয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো তা প্রকাশ করে না। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে বলা হলেও তা অস্বীকার করে বলে জানা গেছে। তবে সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনায় কয়েকটি ব্যাংককের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্কও করা হয়েছে। পাশপাশি যে কোনো ধরনের ঋণ দেওয়ার আগে মর্টগেজের কাগজপত্র অধিক যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কেওআইসি ছাড়া (তোমার গ্রাহককে জানো) ব্যাংক ঋণ দিতে নিরুৎসাহিতও করা হচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ব্যাংকগুলো সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে চললে এবং কেওআইসি অনুসরণ করলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এ জন্য ব্যাংকারদের স্বচ্ছতা, সচেতনতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ঋণ পদ্ধতিতে মারাত্মক ত্রুটি আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই জালিয়াতির ঘটনা বেশি ঘটে। রাজনৈতিকভাবে পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ ঋণ জালিয়াতির একটি বড় কারণ। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যাংকারদের হাতে দিতে হবে। একই সঙ্গে পদোন্নতির ক্ষেত্রে দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিতে হবে। যে কোনো ধরনের ঋণপ্রস্তাব অধিক যাচাই-বাছাই করতে হবে। এসব জালিয়াতির ঘটনা এড়াতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর